ইস্রাফিল রনি:
আমাদের সমাজ ভয়াবহ অসহিষ্ণু ও উগ্রবাদের দিকে যাত্রা করছে।সামাজিক ও ধর্মীয় জিবনে কোথাও সহনশীলতা নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সাইকেপ্যাথ বা মানসিকভাবে অসুস্থ না হলে,মানবিকগুণ না হারালে কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠির পক্ষে কোনো সম্মিলিত খুণ সম্ভব হয়না।
আমাদের দেশে অন্যান্য অপরাধের মত গনপিটুনিও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কোনো গুজব, কারণ অনুসন্ধান ব্যাতিত অথবা সন্দেহের বশে উত্তেজিত জনতা এককের উপর ঝাপিয়ে পড়ে হত্যা করছে সাথে লাশ পুড়িয়ে দেয়া অঙ্গহানি করার মত ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে।
তবে এসব হত্যার ইতিহাস নতুন নয় বরং সদূরপ্রসারী। আমরা ইতিপূর্বেও রাজনৈতিক চত্রছায়ায় সম্মিলিত হত্যা এবং লাশের উপর নৃত্যের চিত্রও দেখেছি। গণপিটুনি শব্দের আভিধানিক অর্থ গণপ্রহার একে প্রচলিত অর্থে গণধোলাই বলা হয়। গণপিটুনির ঘটনা সারা পৃথিবীব্যাপি ‘মব লিঞ্চিং’ নামে পরিচিত। যখন কোনো উত্তেজিত জনতা দ্বারা এককের / দলের উপর অতর্কিত হামলা চালানো হয় তাকে গণপিটুনি বলে।
এ নিয়ে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ‘গুস্তাভ লে বোঁ’ বলেন,জনতার ভিড়ে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্বার বিলুপ্তি ঘটে। জনতার সম্মিলিত মন তখন বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা মোতাবেক কাউকে গনপিটুতে মেরে ফেলা হলে তা খুণ হিসেবে গন্য হবে যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।পূর্ব শত্রুতার জের ধরে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয় ৩০২/৩৪ ধারায়। তবে একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো তা হলো, একক হত্যা আর সম্মিলিত হত্যার সাইক্লোজিক্যাল প্রেক্ষাপট এক নয়। অন্যান্য হত্যাকারীদের একটি অপরাধ প্রবণতা কাজ করে তারা এটি নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকে।
কিন্তু সম্মিলিত হত্যাচিত্রগুলো দেখলে মনে হয় তারা এ হত্যার দ্বারা সমাজ কে পাপমুক্ত করে সংস্কার করছে। নিজেরা এর দ্বারা পূণ্য অর্জন করছে। আইন বিচার সকল কিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা নিজেরা গণআদালত সৃষ্টি করে বসে। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সংবিধান এবং মানবাধিকার সনদের পরিপন্থী।
বাংলাদেশে গণপিটুনি ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকেই দায়ী করা যায়। মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো মানুষ যখন আইনি প্রতিকার লাভে ব্যর্থ হয় তখনি আইনের উপর অনাস্থায় ভুগে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার একটি কারণ এটি। বিচারহীনতা, আইনের ফাঁকফোকর, দীর্ঘসূত্রিতার জন্যই মানুষ আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আর এ জন্যই এখন সাধারণ মানুষ খুণি, ধর্ষক সহ অন্যান্য অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া না চেয়ে ক্রসফায়ারের আন্দোলন করে।
মানবাধিকার সংস্থা (আসকের) তথ্যমতে, ২০১১-২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে ৮০০ মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে কিন্তু এর কোনোটির উল্লেখযোগ্য কোনো বিচার হয়েছে এমন তথ্য নেই। দ্বিতীয়ত এসব সহিংসতার জন্য মানুষের নির্বিকার হিংস্র মনোভঙ্গি এবং অপরাপর মানুষের নিস্কিয়তা দায়ী।
গবেষক রাজীব নন্দীর মতে রাষ্ট্র এ দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেনা। এ বিষয়ক আইনজীবীদের মতে ভিক্টিম পরিবার গুলোর নির্লিপ্ততার জন্যও এসব মামলাগুলো বেশিদিন আগায় না। এখানে মূল কারণ হলো মানুষ আইনের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনা।
আবার পুলিশবাদী মামলা গুলোতে অনেক অজ্ঞাত আাসামী থেকে থাকে আর পরিবার গুলোর অভিযোগ এবং মামলা চালিয়ে যাবার সদিচ্ছার অভাবেও এসব মামলার অগ্রগামী নেই। আমি এখানেও রাষ্টকে দায়ী করতে চাই কারণ কেউ অভিযোগ করুক বা না করুক রাষ্ট্রের উচিত বিষয়গুলো অনুসন্ধান করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
সবশেষে বলতে চাই মানব সভ্যতা এবং আধুনিকতার স্বর্নযুগেও এমন বর্বর, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলতে দেয়া যায়না। সরকারের এখনি সময় এরুপ বীভৎসতার ইতি টানতে আগ্রহী হওয়া এবং এসব উগ্রবাদীদের বিচারের আওতায় এনে এসব অন্যায়ের প্রতি ভীতি সৃষ্টি করা। আমি মনে করি ধর্মীয়, সামাজিক কুসংস্কার মুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা কমিয়ে জনপ্রশাসনের ক্রিয়াশীল মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে সু বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে এমন অপরাধ অনেকটা কমিয়া আনা সম্ভব হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী,
আইন বিভাগ, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।