মনের তাড়না থেকেই গান লিখি: বাকীউল আলম

আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয় ও কিংবদন্তি একজন গীতিকারের নাম বাকীউল আলম। নব্বই দশকে অডিও শিল্পের বৈপ্লবীক পরিবর্তন আনতে যে সকল গীতিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি । তার সৃজনশীল কথামালায় অসংখ্য জনপ্রিয় গান অনেক তরুণের অনুপ্রেরণা ও স্বপ্নের সঙ্গী হয়েছিল। তার লেখা গানের সংখ্যা প্রায় ১৫০০ (পনের শতাধিক) এর বেশি এবং এর মধ্যে রয়েছে অনেক জনপ্রিয় গান। সম্প্রতি আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে বাকীউল আলমের জীবনের কিছু স্মৃতিময় কথা।


লেখালেখিতে এলেন কেন? 
বাকীউল আলম : ছন্দের ওপর চরম দুর্বলতা সেই ছোটবেলা থেকেই। বয়স যখন সাত কি আট, প্রাইমারি স্কুলে পড়ি তখন চয়নিকা নামে একটা পাঠ্য বই ছিল। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত বইটা ক্লাস ভেদে পড়ানো হতো। নিজের পাঠ্য চয়নিকার সমস্ত ছড়া মুখস্থ করে জুনিয়র সিনিয়র ক্লাসের ও সমস্ত চয়নিকা মুখস্থ ছিল। মামুদ মিয়া বেকার, মোদের ছিল বিড়াল মনি, মালয় দ্বীপের শেয়াল-এর ছন্দ চুম্বকের মতো টানতো। মাহমুদুল্লাহ, হোসেন মীর মোশারফ, ফয়েজ আহমেদ, সুকুমার বড়ুয়ার ছন্দে মাতাল ছিলাম আমি। তারপর পত্রিকায় শিশুতোষ পাতাগুলো বেরোতো, তাতে প্রকাশিত ছড়াগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, ফারুক হোসেন, ফারুক নওয়াজদের ছন্দ পড়তে পড়তে একসময় নিজের নামটা ও ছাপার হরফে দেখার স্বপ্ন বুনতে শুরু করলাম। পনেরো বছর বয়সে প্রথম ছড়া ‘তথ্য অধিদপ্তর’ থেকে প্রকাশিত শিশু বিষয়ক পত্রিকা ‘মাসিক নবারুণে’ প্রকাশিত হলো। চলে এলাম ছন্দের জগতে।


এই প্রেম কি অনেক বড় হয়ে এসেছে জীবনে, নাকি শৈশব থেকেই অটুট রয়েছে?
বা আ: সেই যে ক্লাস ওয়ান টু-তে পড়ার সময় ছন্দের টানে মনের খেয়ালে লেখালেখিতে এসেছি, তারপর বহুবার আমি লেখালেখি ছাড়লেও লেখালেখি আমাকে ছাড়েনি।

কবিতা, ছড়া, গদ্য, গান- সাহিত্যের কোন শাখায় আপনার বেশি টান? 
বা আ: সাহিত্য জগতে আমাকে সবচে বেশি টানে ছড়া। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত এর দোলা চালে সবসময় দুলি। আমার লেখা প্রথম দিকের গানগুলিও ছিল সের্‌ফ ছড়ার ছন্দে, যেমন ‘ভুলে যেতে পারি আমি যদি তুমি চাও- বুক থেকে স্মৃতি গুলো মুছে দিয়ে যাও’ এরকম ৮/৫, ৮/৬ মাত্রার ছড়ার ছন্দের উপর ভর করে একসময় গান লিখতে শুরু করি।

দেশে এখন গান না জানা শিল্পী বা গানের গ্রামার না জানা গীতিকার-সুরকারের দোরাত্ম্য চলছে বলা যায়। তাদের অনেকেই এখন খ্যাতির শিখরেও রয়েছে- ব্যাপারটা বাংলাদেশের গানের জন্যে কতটা মঙ্গলময় হচ্ছে?

বা আ: বর্তমান সময়ে শুদ্ধ ব্যাকারণ জানা সুরকার গীতিকারের সত্যিই অভাব। তারপরেও যে নেই তা না। সুরের ভিতর যেমন মুন্সীয়ানা দেখানো যায় তেমনি গান লেখার মধ্যেও মুন্সীয়ানা আছে। আমার মতে, একটা গান লিখতে গেলে তিনটা দিকে খেয়াল রাখা উচিত। ছন্দ, বিষয় বৈচিত্র্য ও উপস্থাপনে চমক। এই তিনটার সামঞ্জস্য না হলে পরিপূর্ণ গান হয় না। সাময়িকভাবে খ্যাতি পেলেও সেই গান স্থায়িত্ব পায়না। আমার মতে ইউটিউবে কোটি ছাড়ানো ভিউ তথা হিট করার জন্য গান না লিখে নিজে পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে গানটা শুনতে পারবো সেই চেষ্টা করা উচিৎ। নিজের চেয়ে বড় শ্রোতা ও সমালোচক আর কেউ নেই।বর্তমান সময়ের গানকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সুর ও অসুর। একজন গায়ককে গ্রামার জেনে গানে আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। শিল্পী যদি সুরের হাত ধরে হাঁটতে পারেন তবেই তার স্বার্থকতা। আর অ-সুর তো ‘অসুর’ই। অসুর এর সাথে শুধুমাত্র বধ শব্দটাই মানান সই।


তবে কেউ গান লেখার সঠিক নিয়ম না জানলেও যদি ভেতরে গান লেখার তাড়না অনুভব করে, তবে কি সে গান লিখবে না?

বা আ: গীতিকাররা মনের তাড়না থেকেই গান লিখে। আর পৃথিবীতে কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়ে জন্ম নেয় না। কেউ যদি তাড়না অনুভব করে তবে অবশ্যই লিখবে। লিখতে লিখতে শিখবে, শিখতে শিখতে লিখবে। তবেই একসময় বহু হিট গানের গীতিকার না হোক বহু ভালো গানের গীতিকারতো হবেই হবে। তবে তার সাথে আর একটা জিনিষ লাগবে সেটা হলো ভালো ভালো গল্প উপন্যাস ও কবিতা পড়তে হবে।

গান লেখা নিয়ে আপনার জীবনে অনেক মজার ঘটনা আছে অবশ্যই, সে সম্পর্কে বলুন।

বা আ: তখন আমি সবে গান লেখা শুরু করেছি। আমার লেখা তপন দা, শুভ্র দার দুয়েকটা গান মার্কেটে এসেছে। তার মধ্যে তপন দার ভুলে যেতে পারি গানটা তুমুল হিট। তখন ছড়াকার হিসেবে ও খুব ব্যস্ত ছিলাম বিধায় একটা জনপ্রিয় শিশু কিশোর পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধ ছিল তপন দা ও শুভ্র দা’র কৈশোর নিয়ে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। অনেক চেষ্টা তদবীর করে শুভ্র দা’র কাছ থেকে সময় পেলাম। দাদার মীরপুরের বাসায় গেলাম সাক্ষাৎকার নিতে। শুভ্র দার জনপ্রিয়তা ছিলো তখন আকাশ ছোঁয়া। দাদার সান্নিধ্যে উত্তেজিত সেই সম্পাদক সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করে নেয়ার জন্যে তার ওয়াকম্যান শুভ্রদার সামনে ধরে চলতে লাগলো দাদার সাথে তার শৈশব ও কৈশোর নিয়ে আলোচনা। চা নাস্তা খেতে খেতে প্রায় আধা ঘন্টার আলাপচারিতা ওয়াকম্যান বন্দী করে হাসি মুখে দাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজন মিলে একটা বিআরটিসি দোতলা বাসের দোতলায় উঠে বসলাম। রেকর্ডিং কেমন হয়েছে দেখার জন্যে সাথের সম্পাদক ভাই ওয়াকম্যানটি প্লে করে বুঝতে পারেন এতক্ষন তাতে রেকর্ড এর লাল বাটনটি চাপ না দিয়ে শুধু প্লে বাটনটি চাপা ছিল। ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটটি ব্ল্যাঙ্কই রয়ে গেছে। পরে দুজন মিলে সদ্যঘটা স্মৃতি থেকে একটা সাক্ষাৎকার বানিয়ে ছেপেছিলাম।

ঢাকা শহরে ব্যাস্ততার জন্যে অনেক লেখক এখন মোবাইলের নোট প্যাডে কবিতা, ছড়া বা গান লিখে রাখেন। আপনার জীবনে এমন ঘটনা আছে কি? 
বা আ: প্রযুক্তি সব সময়ই সবচে বড় সহায়ক ও বন্ধু। আমি যখন ব্যস্ত গীতিকার ছিলাম তখন মোবাইল ফোন, নোট প্যাড ছিল না। পকেটে কলম থাকতো। সাথে কাগজ না থাকলে দেয়াল থেকে পোষ্টার ছিঁড়ে তাতে শর্ট নোট রাখতাম পরে অবসর সময় তা থেকে গান বানাতাম।

চাকুরি ও লেখালেখি- কোনটায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
বা আ: চাকুরি ও লেখালেখি দুইটা আসলে দুই মেরুর। একটা হচ্ছে পেটের খোরাক আরেকটা মনের। জীবনের তাগিদে জীবিকা প্রাধান্য পায় বিধায় লেখালেখিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও চাকুরিটা বেশি প্রাধান্য পায়। আমাদের দেশের গীতিকাররা শুধুমাত্র গান লিখে জীবিকা নির্বাহ করার অবস্থায় নেই এবং আগামী পঁচিশ বছরেও যাবে কিনা সন্দেহ।