বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়ে যা খুশি লেখা যায়

আলতাফ পারভেজ নামে একজন কলাম লেখক প্রথম আলোতে ‘লাখো ভর্তিযোদ্ধা এবার রেহাই চান’ শিরোণামে কলাম লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেভাবে হেয় করেছেন, মানহানি করেছেন, অর্থলোভী বলেছেন তাতে তার রুচিবোধ, শিক্ষা-দীক্ষা, মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। কোন বিষয়ের পক্ষে- বিপক্ষে তথ্য-যুক্তি দিয়ে লেখা যেতেই পারে। কিন্তু একটি পেশার মানুষকে সমাজের চোখে এভাবে মূল্যহীন করার অপপ্রয়াস দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। পৃথিবীর কোন কোন দেশে একসাথে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয়? তিনি নিজেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গবেষক দাবি করেছেন। এশিয়ার এ দেশগুলোর কোনটিতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা একসাথে হয়? সে অভিজ্ঞতা তুলে ধরুণ জাতি উপকৃত হবে, সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার পক্ষে যুক্তি জোরালো হবে। সমন্বিত পরীক্ষার পথি চলা মসৃণ হবে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অর্থলোভী বলেছেন। কত শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বাড়ি-গাড়ি আছে? অর্থলোভী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এত টাকা কোথায় রাখেন? সুইস ব্যাংকে? না কি কানাডা, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে বিনিয়োগ করেছেন? আমার জানা মতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৯৯ শতাংশ সর্বশেষ ভর্তি পরীক্ষায় জনপ্রতি গড়ে ২০ হাজার টাকার বেশি পেয়েছেন বলে মনে হয় না। আর এ জন্য ভর্তি পরীক্ষার ৫-৬ দিন তাদেরক সকাল থেকে রাত ৯-১০টা অবধি ব্যয় করতে হয়েছে? এ বাংলাদেশে এমন সরকারি চাকুরি আছে যেখানে ২০-২৫ হাজার টাকা একদিনে সিটিং এ্যালাউন্স পাওয়া যায়। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও উপাচার্যদের সভা আগামি ১১/ ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত। তার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে এমন বিষোদগার, কুরুচিপূর্ণ, ও বিদ্বেষমূলক লেখা কিসের ইঙ্গিত? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিরীহ, ক্ষমতাহীন। তাদের অপরাধ তারা লেখা-পড়া শেষে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন দেশের মমতায়। আমি যে বিভাগে শিক্ষকতা করি, সেখানে আমার দুজন ছাত্র উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করে দেশে ফিরে আবার চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে একজন অষ্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্বদ্যিালয়ে, আরেকজন সুইজারল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন বেশ কয়েক বছর হলো। বাংলাদেশে এমন শত শত শিক্ষক আছেন যারা অনায়াসেই বিশ্বের যে কোন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি নিয়ে চলে যেতে পারেন। নিরাপদ, স্বচ্ছল জীবন-যাপন করতে পারেন। কেবলমাত্র দেশকে ভালোবেসে, সামান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এ দুজন চলে যাওয়ায় খুব মন খারাপ হয়েছিলো,তাদের মেধা দিয়ে দেশকে সেবা করলো না বলে। এখন মনে হচ্ছে চলে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। নিদেনপক্ষে এরুপ কলাম লেখকের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে মান-সম্মান হারাতে হয়নি তাদের। অন্য পেশার কাউকে নিয়ে এমন করে লিখেন, পিঠের চামড়া বাঁচাতে এ দুয়ার ও দুয়ার ঘুরতে হবে। এ বাংলাদেশে কোন কোন সরকারি চাকুরিতে একজন ২-৩টি সরকারি গাড়ির সুবিধা নিজে,সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন নিয়ে ভোগ করে থাকেন। কিছু চাকুরিতে নাম মাত্র মূল্যে সরকারি প্লট-ফ্ল্যাট পেয়ে থাকেন। বেতনের সমান অন্যান্য ভাতা, রেশন, প্রান্তিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। আর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এসব দূরে থাক ৪০-৪৫ বছরের কর্মজীবনে বাস ছাড়া একবারের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট গাড়িতে চড়ার সুযোগ পান না।
কোনরকম ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে কলেজের মতো এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএর ভিত্তিতে ভর্তির ব্যবস্থা করলে তো শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের আরও কষ্টলাঘব করা যাবে। সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার যেমন সুফল আছে তেমনি মারাত্মক কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সেগুলো প্রতিরোধের জন্য বিস্তারিত আলোচনা ও রক্ষাকবচ তৈরি দরকার। যেমন ধরুন, দেশের কোথাও পরীক্ষা পরিদর্শনে শৈথিল্য হলো, ফলে ঐ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা কয়েক নম্বর বেশি পেয়ে প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একসময় বিশ্বদ্যিালয়ের বাইরে অনেক জায়গায় ভর্তিপরীক্ষা নিতো। একটা স্টাডিতে প্রকাশ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কেন্দ্রগুলো থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। এখন কালেভদ্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষাগ্রহণ করা হয়। বহু নির্বাচনী প্রশ্নে (এমসিকিউ) ভর্তি পরীক্ষায় প্রকৃত মেধা যাচাই না হওয়ায় অনেক অমেধাবীরা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভর্তি হয়ে এরা প্রতিবছরই কোন না কোন বিষয়ে ফেল করে শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত করছে। বিশেষ পরীক্ষা দিয়ে পাসের দাবি করছে সংঘবদ্ধভাবে। ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এমসিকিউ-র পাশাপাশি বর্ণণামূলক প্রশ্ন যোগ করে বিশ্লেষণ দক্ষতা, ভাষা ইত্যাদি পরীক্ষা করার চেষ্টা করছে। সমন্বিত পরীক্ষায় বর্ণনামূলক প্রশ্ন যোগে পরীক্ষা নেয়া ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর মূল্যায়ণে কী কী চ্যালেঞ্জ হতে পারে তা আলোচনা দরকার। ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ টাইপের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমরা প্রাথমিক-মাধ্যমিকে সফল হয়েছি কী? কতবার সিস্টেম বদলাতে হয়েছে? প্রশ্ন ব্যাংক, এমসিকিউ, সৃজনশীল। এখন বলছি শিক্ষকরা নিজেরাই নোট বই-গাইড বই দেখে পাঠদান করছে, প্রশ্নপত্র তৈরি করছে। কারণ মাঠের বাস্তবতা না বুঝেই হুজুগে সিস্টেম চালু করেছি, বদল করেছি বার বার। আর এভাবে বারোটা বেজেছে প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষার। বড় বেশি ত্বরাপ্রবণ আমরা। কাউকে আক্রমণ করার মানসিকতা নিয়ে না লিখে পরামর্শকমূলক লিখুন, তবেই নামের পাশে গবেষক যোগ করা অর্থবহ হয়। গবেষণার নীতি হচ্ছে কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব-বিদ্বেষ থাকবে না। তাই নয় কী?