যে ১১ অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারনে সবার সেরা চবি

বিশেষ প্রতিবেদনঃ

জীবনকে যারা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে ভালোবাসেন, কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে শুধুই পাঠ্য বইয়ের মলাটে আর ইট –পাথরে ঘেরা চার দেয়ালের ক্লাস রুমে আবদ্ধ না করে ক্লাসের
বাইরের জগৎ থেকেও যারা হাজারো শিক্ষা নিয়ে জীবনকে ভিন্ন আঙ্গিকে, নানান অভিজ্ঞতা আর বৈচিত্রময়তায় ভরিয়ে দিতে চান; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে তাদের জন্য আদর্শ পাঠ্যস্থান। দেশের নানান প্রান্ত থেকে আগত প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থীদের পদচারনায় মুখরিত – প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত এই বিদ্যাপীঠ আপনার জীবনে বৈচিত্রের দ্বার খুলে দিতে উন্মুখ হয়ে আছে। সারিসারি গাছের সমারোহ আপনাকে চবিতে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত।

১। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিঃ

কবি সত্যিই বলেছেন, আমাদের দেশ পৃথিবীর সৌন্দর্যের রাণী। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন, ঐতিহাসিক স্থাপনা, বিস্তীর্ণ পাহাড় রাশি, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, অফুরন্ত সবুজের সমারোহ সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা থেকে দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন প্রকৃতি আর মানব প্রাণের মিলনস্থল। সবুজ বৃক্ষসারির উপর উড়ন্ত বিচিত্র রঙের হরেক রকম পাখি, প্রজাপতি, অজগর কিংবা বিচিত্র রকমের দুর্লভ প্রাণীর জীবন্ত জাদুঘর চবি ক্যাম্পাস। ঝুলন্ত সেতু, ঝর্ণাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান কিংবা সুবিশাল মাঠ কি নেই চবি ক্যাম্পাসে! পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিরিপথের দেখা পাওয়া যায় কিনা সেই সন্ধান দিতে পারবেন কি? চবিতে এসে দলবেঁধে ভ্রমণ করতে পারেন অপরূপ সৌন্দর্যের চালন্দা গিরিপথ যা আপনাকে এডভ্যাঞ্জারের পাশাপাশি
অতিমাত্রায় বিমোহিত করবে।

প্রকৃতি প্রেমীরা এখানে নিজেকে খুঁজে পাবেন সবুজের পাতায় পাতায়, দূর পাহাড়ে শেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মাঝে কিংবা শীতের সকালের শিশির বিন্দুতে, প্রকৃতির নির্জনতায় আর রাতের নিস্তব্ধতায়। আর যারা চট্টগ্রামের বাইরে থেকে আসবেন তারা খুব সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ফাঁকে ফাঁকে চাইলে দেখে নিতে পারেন কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়ির বৈচিত্রময় প্রকৃতি আর পাহাড়ি জনপদের
জীবনযাত্রা। ক্লাসের বাইরের এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আপনাকে নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি আত্ববিশ্বাস আর কর্মতৎপরতা বাড়াতেও সহায়তা করবে। প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান আর মায়া হরিণের দেখা পাবেন চবিতে।

২। বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনের ক্যাম্পাসঃ

চবি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে এখনো শাটল ট্রেন এখনো চলাচল করে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ বলা হয় এই শাটল ট্রেনকে। এই শাটলেই প্রতিদিন হাজারো প্রাণের মেলা বসে। গল্প আড্ডা আর গানে মুখরিত হয়ে উঠে এই শাটল ট্রেন। এই ট্রেনের বগিতে গান করে অনেকেই হয়েছে বিখ্যাত গায়ক। তাই চবিকে গানবাজদের তীর্থস্থানও বলা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যয়ন শেষে এখানকার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশী যা মিস করে তা হলো এই শাটলের আড্ডা আর গান। গল্প আড্ডা আর গানে মুখরিত হয়ে উঠে এই শাটল ট্রেন।

৩। মায়া হরিণের ক্যাম্পাসঃ

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়, বাণিজ্য অনুষদের পেছনে, ফরেস্ট্রি এলাকা, বিজ্ঞান অনুষদের পাশে, শাহজালাল হলের এক্সটেনশন সহ অন্যান্য সবুজ পাহাড়ের কোলে প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা ছোট আকারের লালচে বাদামী পিঙ্গল রংয়ের মায়া হরিণের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। যা বাংলাদেশে বিরল।

৪। অসাধারণ ফ্যাকাল্টিঃ


বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যার , নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যার , বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান স্যারের মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা শিক্ষকতা করেছেন চবিতে। পুরাতন
ধ্যান- ধারণা ভেঙ্গে গুরু শিষ্য সম্পর্কের গন্ডি পেরিয়ে চবির শিক্ষক, শিক্ষার্থীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক সম্পর্ক যেন জীবনের অন্য রকম অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা দেয়। এখানে রয়েছে M.Phil., PhD, M.D., M.P.H এর মতো উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহনের সুযোগও।

৫।বরেণ্য ব্যাক্তিদের ক্যাম্পাসঃ


এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অধ্যয়ন করেছেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপ্রতি সুরেন্দ্র কুমার
সিনহা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১ তম গভর্নর ফজলে কবির, পুলিশের সাবেক আইজি প্রয়াত আনোয়ারুল ইকবাল সহ বহু বরেণ্য আর গুণীজন। বিশেষ দিনে দেখা মেলে সম্মানীত এলাইমনাইদের।

৬। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরঃ

১৯৭৩ সালের ১৪ই জুনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একমাত্র অ্যাকাডেমিক জাদুঘর যা মূলত মানব ইতিহাস, শিল্প এবং সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সহায়তা প্রদান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং এ সকল বিষয়ে মৌলিক গবেষণার সু্যোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। এটি চট্টগ্রামের একমাত্র শিল্প জাদুঘর এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যেও একমাত্র জাদুঘর হিসেবে
বিবেচিত। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে রয়েছে ‘প্রাণীবিদ্যা জাদুঘর’, আবার বিশ্ববিদ্যালয়েরই সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সমুদ্র সম্পদ যাদুঘর’ যেখানে ৫৫০টির
মতো সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে।

৭। তৃতীয় বৃহত্তম গ্রন্থাগারঃ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার যা দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। এই গ্রন্থাগারে বর্তমান সংগ্রহ সংখ্যা প্রায় ৩.৫ লক্ষ যার মধ্যে রয়েছে বিরল বই, জার্নাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল উপাদান, পান্ডুলিপি এবং অন্ধদের জন্য ব্রেইল বই। গ্রন্থাগারটিকে বর্তমানে অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে।

৮। চবির স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্যঃ


বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের সাথে চবির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের
মুক্তিযোদ্ধারদের আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ নির্মিত ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে “বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ’। স্তম্ভটির অবস্থান বুদ্ধিজীবী চত্বর নামে পরিচিত। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের বিপরীত পাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে রয়েছে নবনির্মিত ‘স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল’, এতে ৪টি পাখির প্রতীকী নির্মাণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির ছয় দফা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রমধারা এবং পাখির ডানায় ২১টি পাথরের টুকরায় লিপিবদ্ধ হয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি। এছাড়া শহীদ মিনার ও বুদ্বিজীবি চত্ত্বরের মাঝখানে রয়েছে জয় বাংলা ভাস্কর্য। এতে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

৯। অনন্য আবাসিক হলঃ


পাহাড় ঘেরা প্রকৃতির কোলে চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে ১৩টি আবাসিক হল যার মধ্যে ৭টি ছাত্র হল ও ৪টি ছাত্রী হল এবং
২টি নির্মানাধীন হল। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১টি দৃষ্টিনন্দন হোস্টেলও রয়েছে। প্রতিটি হলের নির্মাণশৈলী যেমনি আলাদা তেমনি হল গুলো কোনটা পাহাড়ের কোল ঘেষে আবার কোনটা পাহাড় আর নয়নাভিরামসবুজের ঘেরা যেন এক স্বপ্নপূরী। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দূর পাহাড়ে পাখির কলতান, জোনাকির মৃদু আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পুরো ক্যাম্পাসকে করে তুলে আরো আকর্ষণীয়।

১০। উৎসবের ক্যাম্পাসঃ


চবি এখন আর মামা–চাচাদের সময়কার উৎসবহীন পুরোনো ক্যাম্পাস নয়। সকল হীনতা আর শীর্ণতাকে পেছনে ফেলে চবি এখন এগিয়ে চলছে দূর্বার গতিতে তার আপন সাফল্যের পানে। বাঙ্গালীর বৈশাখী উৎসব থেকে শুরু করে, পহেলা ফাল্গুনেও নতুন সাঁঝে ধরা দেয় চবি ক্যাম্পাস। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে প্রোগ্রাম, বই মেলা আর সারা বছর ব্যাপী বিভিন্ন কালচারাল সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত নানান প্রোগ্রাম চলতেই থাকে। এছাড়া চবির বিভিন্ন বিভাগের আয়োজনে আয়োজিত ‘নবীন বরণ ও র্যাগ ডে’ গুলোকে দেশ সেরা স্বীকৃতি দেয়া যায় অনায়াসেই। কালার ফেস্টুন আর মুখোশ সম্বলিত বিশাল র্যালী আর ফ্ল্যাশ মোব আর আতশবাজি এখানকার র্যাগ
ডের প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া আয়োজন হয় বিভিন্ন বিভাগের বর্ষ পূর্তি, যুগ পূর্তি, ২৫ বছর পূর্তিতে সিলভার জুবিলী সহ নানান রঙ্গীন অনুষ্ঠানের। আর দেশ সেরা শিল্পীদের নিয়ে কনসার্ট আয়োজন চবিতে নিয়মিত ঘটনায় বলা যায়। নবীনদের বরণ ও বিদায়ী শিক্ষার্থীদের বিদায় জানাতে হরমামেশাই জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় চবিতে।

১১। ঐতিহাসিক মউর দোয়ানঃ

এখানে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাম্পাস থেকে ২২ কিঃ মিঃ দূরে শহরে অবস্থান করেই হাজারো তারুণ্যের স্পন্দন অনুভব করা শুরু করবেন। শাটল ট্রেন বা রেল স্টেশন থেকে কাটা পাহাড়, সমাজ বিজ্ঞান থেকে বুদ্ধিজীবী চত্ত্বর, শামসুন্নাহার থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন , ফরেস্টি থেকে হেলিপ্যাড কিংবা কলা অনুষদের ঝুপড়ী থেকে বিজ্ঞান অনুষদ সর্বত্র সর্বদা প্রাণের চাঞ্চল্য বিরাজ করে।