কামাল তখন অল্প কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি, ও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল, পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি।
ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল- ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?” (‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বই থেকে নেয়া)
খেলাধুলা, বক্তৃতা, সংগীত ও অভিনয়সহ বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জৈষ্ঠ্যপুত্র “শেখ কামাল”। মাত্র ২৬ বছরের জীবনে বাঙালির সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এক অনন্য প্রতিভাবান সংগঠক ও উদ্যোক্তা হিসেবে। স্বল্প সময়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অসামান্য উচ্চতায়। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ কামাল।
শৈশব থেকে খেলাধুলায় ছিলো তার প্রচন্ড ঝোঁক। ক্রিকেটের প্রতি আবেগ এবং দীর্ঘকায় শারীরিক গঠন নিয়ে নিজেকে একজন কার্যকরী ফাস্ট বোলার হিসেবে তৈরি করেছিলেন “শেখ কামাল”। বাঙালি এবং মুজিবপুত্র হবার কারণে অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে নিদারুণভাবে উপেক্ষিত থেকেছেন। শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিকে থাকাকালীন শেখ কামাল শাহীন স্কুলের তিতুমীর হাউজ-এর ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র হিসেবে হলের বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন “শেখ কামাল”। বাস্কেটবলে তার অসামান্য দক্ষতার কারণে ঐ সময়ে বাস্কেটবলে সলিমুল্লাহ হল শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল। খেলাধুলার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ক্রীড়াঙ্গনের প্রসারের লক্ষ্যে দেশের অন্যতম শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ক্লাব ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আবাহনী ক্রীড়াচক্রের অধীনে তিনি হকি, ক্রিকেট এবং টেবিল টেনিস দলও গঠন করেন। পরবর্তীতে আবাহনী ক্রীড়াচক্র বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের জন্ম দেয়।
সংগীত শিল্পেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন শেখ কামাল। তিনি ‘ট্যালেন্ট শো-এর প্রবর্তন করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে সেতার বাজাতে খুব পছন্দ করতেন শেখ কামাল। ছিলেন ছায়ানটের সেতার বাদন বিভাগের শিক্ষার্থী। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের’ কাছে নিজ বাড়িতে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিতেন। আন্ত:কলেজ সেতার প্রতিযোগিতায় পুরো পাকিস্তানে তিনি রানার্স-আপ এবং আন্ত:কলেজ সংগীত প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পূর্বে তিনি মৃদঙ্গ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৯-এ পাকিস্তান সামরিক সরকার ‘রবীন্দ্র সংগীত’ নিষেধ করলে শেখ কামালের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠে রবীন্দ্র সংগীত। সেসময় তিনি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের সংগঠিত করেন এবং বিভিন্ন সভা এবং জমায়েতে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দিয়েও গাওয়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিভিন্ন আন্দোলন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্র সংগীতের মাধ্যমে অহিংস পন্থায় প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন শেখ কামাল।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নাট্যাঙ্গনেও সুখ্যাতি অর্জন করেন তিনি। বাংলা একাডেমির মঞ্চে অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার অভিনীত নাটক নিয়ে ভারত সফর করেছেন। বিখ্যাত কবর নাটক মঞ্চস্থ করেছেন কলকাতার মঞ্চে। এছাড়া তার অভিনিত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব হামিদের নির্দেশনায় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দি ডেভিল’ অবলম্বনে ‘দানব’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, আল মনসুরের লেখা ‘রোলার এবং নিহত এলএমজি’ এবং ‘আমি মন্ত্রী হব’ অন্যতম। তিনি আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন।
নাট্য সংগঠন ‘ঢাকা থিয়েটার’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা “শেখ কামাল”। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি তার তত্বাবধানে সৃষ্টি হয় “স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’। সংগীতের সাথে জড়িত তরুণদের অন্যতম ঠিকুজি হয়ে উঠে দলটি। লোকজ থেকে আধুনিক, সব ধরনের গানের চর্চা হতো এখানে। সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন শেখ কামাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘র্যাগ-ডে’তে রং মেখে উদযাপন করার পরিবর্তে র্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ছবি প্রদর্শনী ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পালন করার প্রস্তাব করেছিলেন।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলিষ্ট নেতৃত্বের অধিকারী শেখ কামাল
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্মের বছরে শেখ কামালের জন্ম। আওয়ামী লীগের পথচলার যে ধারাবাহিকতা, বঙ্গবন্ধুর জীবন পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, তার প্রভাব শেখ কামালের জীবনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। ছাত্রলীগের কর্মী এবং সংগঠক হিসেবে ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী শেখ কামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর থেকে অত্যন্ত চৌকষ ও মেধাবী তরুণ, যুবক ও পেশাজীবীদের মধ্য থেকে ৬১ জনকে জেন্টলম্যান ক্যাডেট (জিসিএস) হিসেবে নির্বাচিত করে ভারতের অফিসার ট্রেনিং উইংয়ে (ওটিডব্লিউ) ন্যাস্ত করে বর্তমান উত্তরাখণ্ড প্রদেশের দেরাদুনে হিমালয় পর্বতের সন্নিকটে মূর্তি ক্যাম্পে প্রেরণ করে। শেখ কামাল ছিলেন সেই ৬১ জন সৌভাগ্যবান তরুণদের একজন, যারা ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট ওয়ার কোর্স সমাপন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। প্রথম যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কোর্সটি ‘৭১ সালের জুনের শেষে শুরু হয় এবং একই বছর ৯ অক্টোবর অংশগ্রহণকারী সদস্যদের ‘পাসিং আউট’ হয়। অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে ১৬ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কোর্সটি চলমান অবস্থায় শেখ কামাল কখনোই অসুস্থবোধ করেননি। তার শারীরিক ফিটনেস এবং পারফর্মেন্স ছিল সবার উপরে। তিনি সেই প্রশিক্ষণ কোর্সে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন শেখ কামাল। তার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সম্মেলনের প্রধান অতিথি তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেছিল। ছাত্রলীগের সংগ্রামী, আদর্শবাদী কর্মী হিসেবে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন শেখ কামাল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে প্রথম শহীদ “শেখ কামাল”। যেই মাসে তার জন্ম সেই মাসেই শাহাদাৎ বরণ করলেন শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধু স্ব-পরিবারে নিহত না হলে বাংলাদেশ পেতো বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী- একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ক্রীড়াবিদ ও দক্ষ সংগঠক এই নেতাকে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি তরুণদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন “শেখ কামাল”কে।
শফিকুল ইসলাম (শাওন)
উপ-প্রচার সম্পাদক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ