ফাহমিদা স্নিগ্ধা (সাহিত্য ডেস্ক)
১৯৭১, পূর্ব পাকিস্তানে তখন তুমুল উত্তেজনা। প্রতিদিনই বিপ্লবী বাঙালির মিছিল-মিটিং, হরতাল আর দখলদার পাকিস্তান সরকারের কারফিউ, নানান নিষেধাজ্ঞা। এই সময়টিকেই ধারণ করে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখতে শুরু করলেন দিনলিপি। ব্যাক্তিগত এই দিনলিপি পরিণত হল বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও হানাদার বাহিনীর বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের দলিলে। পরবর্তীতে জাহানারা ইমামের দিনলিপিটি ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। দিনলিপির সময়কাল শুরু হয়েছে একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকে, আর শেষ হয়েছে ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর।
বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে এক দগদগে ঘা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। জাহানারা ইমাম ছিলেন এর প্রত্যক্ষদর্শী। শুধু তাই নয়, বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে তিনি নিজ সন্তান শফি ইমাম রুমিকে উৎসর্গ করে দেন এই বলে- ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।’ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনার পর ২৯ আগস্ট সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক হয় রুমি। একইসঙ্গে আটক করা হয় রুমির বাবা শরীফকেও। পরে শরীফ ফিরে আসলেও রুমি আর ফেরেনি মায়ের কোলে। দেশের জন্য শহীদ রুমির আত্মদান এবং জাহানারা ইমামের ‘কোরবানি’র কারণে পরবর্তীতে জাহানারা ইমাম ভূষিত হন ‘শহীদ জননী’ উপাধিতে। তিনি শুধু পুত্র রুমীকেই হারাননি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রেমাস্পদ স্বামীকেও হারিয়ে ফেলেন। রুমীর সাথে আটকের পর ফিরে আসলেও ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন শরীফ। হাসপাতালে ভর্তি হলে ‘ব্ল্যাক আউটে’র কারণে চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যবরণ করেন তিনি।
এসব ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে। স্থান পেয়েছে ৭ মার্চের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর বাঙালির ঘরে ঘরে পতপত করে স্বাধীন পতাকা উড্ডয়নের সব ঘটনাই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রদানের দিন অর্থাৎ ৭ মার্চের লিপিটি পড়লেই পাওয়া যাবে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির উদগ্রতার পরিচয়। এদিন তিনি লিখেছেন, ‘রেসকোর্স মাঠের জনসভায় লোক হয়েছিল প্রায় তিরিশ লাখের মতো। কত দূর-দূরান্তর থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে, লাঠি আর রড ঘাড়ে করে—তার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর, ডেমরা—এসব জায়গা থেকে তো বটেই, চব্বিশ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে। অন্ধ ছেলেদের মিছিল করে মিটিংয়ে যাওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বহু মহিলা, ছাত্রী মিছিল করে মাঠে গিয়েছিল শেখের বক্তৃতা শুনতে।’
২৫ মার্চ রাতের ঘটনার সাক্ষ দিচ্ছে সেদিনের দিনলিপিটি এভাবে- ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলাম। রুমী-জামী ছুটে এল এ ঘরে। কি ব্যাপার? দু’তিন রকমের শব্দ—ভারি বোমার বুমবুম আওয়াজ, মেশিনগানের ঠাঠাঠাঠা আওয়াজ, চি-ই-ই-ই করে আরেকটা শব্দ। আকাশে কি যেন জ্বলে-জ্বলে উঠছে, তার আলোয় ঘরের ভেতর পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠেছে। সবাই ছুটলাম ছাদে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে মাঠ পেরিয়ে ইকবাল হল, মোহসীন হল, আরো কয়েকটা হল, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার্সের কয়েকটা বিল্ডিং। বেশিরভাগ আওয়াজ সেইদিক থেকে আসছে, সেইসঙ্গে বহু কষ্টের আর্তনাদ, চিৎকার৷’ এভাবেই পুরো ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থটি সাক্ষ দিয়েছে পাক বাহিনী, এদেশীয় দোসর জামাত ইসলামী ও বিহারীদের দ্বারা বাঙালি নির্যাতনের।
দিনলিপি লিখলেও সুসাহিত্যিক জাহানারা ইমামের দরদভরা লেখনীতে একাত্তর উদ্ভাসিত হয়েছে কথাসাহিত্যের মত জটিল অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। শফী ইমাম রুমিকে নিজ ভুখণ্ডের জন্য উৎসর্গ করলেও তার জন্য মাতৃহৃদয়ের উদ্বেলিত আকুলতার গন্ধও পাওয়া যায় গ্রন্থটিতে। একাত্তরের ভয়াবহতা ও স্বজাতির উপর ভয়াবহ আগ্রাসনের ফলে বাঙালির হৃদয়ে কতটুকু যন্ত্রণা গ্রথিত ছিল তা উপলব্ধি করতে এই গ্রন্থ পাঠ জরুরী।
বাংলাবার্তা/এফএস/এমএইচ