ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় আইনি পদ্ধতি!

ইস্রাফিল রনি
 
বিচারহীনতার সংস্কৃতি কথাটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। সময়ে সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতো এ বিষয়ে চরম উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়। আর public perception সব ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক না হলেও ন্যায় বিচারে প্রাসঙ্গিক। কথাই আছে, Justice not only be done, it must be see to be done.সুতরাং আমাদের দেশে ন্যায় বিচারের অন্তরায় কি তা খতিয়ে দেখা দরকার। ন্যয় বিচারের মূল কথা হলো প্রত্যেক ব্যক্তির আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত, স্বাধীন, নিরপেক্ষ, আদালতে প্রকাশ্যে দ্রুত নিরপেক্ষ বিচার। চবির আইনের অধ্যাপক জাকির হোসেন স্যারের মতে ন্যয় বিচারের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো হলো, ১,বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ২,নিরপেক্ষ আদালত ৩,দ্রুত বিচার লাভ ৪,প্রকাশ্যে বিচার লাভ ৫,বিচারকের মেধা ও দক্ষতা।
ফৌজদারি মামলায় ন্যায় বিচারে পুলিশি সুষ্ঠু তদন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।মামলা দায়েরের পর ঘটনা উদঘাটন, সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ,অপরাধ ব্যাখ্যা এসবে পুলিশকে গুরু দায়ীত্ব পালন করতে হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারায় পুলিশি তদন্তে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মামলার এজহার গ্রহন, তদন্ত সম্পাদন সাক্ষীদের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি খুবই গুরুত্বপূর্ন। গত ৪ জুন ২০২০ সালে সমকালের রিপোর্ট অনুযায়ী চার্জশিটভুক্ত ৫৫.৮৭ শতাংশ মামলায় নিম্ন আদালতেই সাজা হয়না। এ বিষয়ে সাবেক আইন মন্ত্রী ব্যরিস্টার শফিক আহমদ বলেন এসব সাজা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্য সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। সাগর রুনির হত্যা মামলায় ৬৯ বার তদন্ত পিছানোর পরও কোনো ফল না পাওয়াই মামলাটি নিস্পত্তি করা যাচ্ছেনা।এতেই ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আমাদের পিবিআই কে আরো সচেতন এবং জোরালোভাবে তদন্তকার্য চালোনোর দিকে নজর দিতে হবে।
ন্যায় বিচারে সাক্ষ্যের বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ আর আমাদের ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। আমরা দেখি দেশে অপরাধী শনাক্তে বিভিন্ন পয়েন্টে,অফিসে সি সি ক্যমেরা লাগানো থাকে দুঃখের বিষয় হলো এসব ফুটেজের কোনো রেকর্ডেই আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমাদের সকল তথ্য প্রমাণ থাকতেও প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের কাছে ছুটতে হয় অনেক সময় তাদের পাওয়াই দুঃস্কর। অবশ্য আইনটি সংশোধনের জন্য ২ জানুয়ারী ২০১৫ সালে আইন কমিশন সুপারিশ করেছেন, বক্তব্যে তৎকালীন চেয়ারম্যান খায়রুল হক বলেন, এই আইন পরিবর্তনে অবশ্যই আমাদের কাজ করে যেতে হবে কারণ বিদেশে স্কাইপিতে সাক্ষীদের সাক্ষগ্রহণ পর্যন্ত করা হয়। পরে তিনি উল্লেখ করেন,আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট খুবই দুর্বল।
২১ আগস্ট ২০১৯ দুদক চেয়ারম্যান আইন মন্ত্রনালয়ে চিঠি প্রেরণ করে বিচারিক কার্যক্রমে ইলেকট্রনিক রেকর্ডকে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অনুরোধ জানান। দেশে ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠায় উক্ত আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবী। মামলার জট আমাদের দেশে ন্যায় বিচারে সবচেয়ে বড় বাধা। আদালতে পুরণো মামলাগুলো ঝুলে থাকায় নতুন মামলাগুলোর গতি মন্থর হয়ে যায়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের শেষে একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮ টি। তখন ধারণা করা হয় ২০২০ সাল অবধি মামলা জটে দাঁড়াবে ৫০ লাখ। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী আপীল ও হাইকোর্টেরর বিচারাধীন মামলা ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪ টি। এ বছরের শুরুতে প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে বিচারাধীন পুরণো মামলা নিষ্পত্তির জন্য ১৫ টি দ্বৈত বেঞ্চকে এখতিয়ার দেন। কিন্তু এখনো সারাদেশে মামলার জট কমেনি। আদালততে ১০ বছরাধীক মামলাগুলোও অধীক হারে পড়ে থাকায় সুষ্ঠু ন্যয় বিচার সম্ভব হচ্ছেনা।
আরেকটি মারাত্নক সমস্যার কথা বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের দেশে বিচারকের সংখ্যা খুবই নগন্য। মামলার জট নিয়ে প্রধান বিচারপতির উদ্বেগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সারাদেশে বিচারকের অপ্রতুলতা আছে। বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য বিচারক মাত্র ১ জন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে বিচারক সংখ্যা মাত্র ১০ জন যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭ জন,কানাডায় ৭৫ জন,অষ্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন, ভারতে ১৮ জন।বাংলাদেশে ১ জন বিচারকের বিপরীতে মামলার সংখ্যা ২১২৫ টি আর ভারতে মাত্র ৩৫০ টি। এসব গুরু সমস্যা ছাড়াও বিচারকদের সুযোগ সুবিধার অভাব, দক্ষতার অভাব,আইনজীবীদের সদিচ্ছার অভাব এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতা উল্লেখযোগ্য। আর আমাদের দেশে ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথা বিচারহীনতার সংস্কৃতি নামক ট্যাগ থেকে এ দেশ কখনো মুক্তি পাবেনা।
 
লেখক: শিক্ষার্থী,
আইন বিভাগ,চট্রগ্রাম বিশ্ববিদালয়
এমডি/এমএইচ/বাংলাবার্তা