স্কুটি হাঁকিয়ে ৬৪ জেলা

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে
আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল নিজের দেশ দেখা, সেই সঙ্গে স্কুলের মেয়েদের সচেতন করা। তবে আরেকটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হলো মোটরবাইকে যে নারীরাও দেশ ভ্রমণ করতে পারেন, এটা প্রতিষ্ঠিত করা। তাই আমরা যে জেলাতেই গিয়েছি, সে জেলার দর্শনীয় স্থান, ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ স্থান ঘুরে বেড়িয়েছি, নতুনভাবে জেনেছি। প্রতিটি জেলা কোনো না কোনো কারণে আলাদাভাবে মনে থাকবে। এর মধ্যেও শেরপুর, সুনামগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল আর রাঙামাটির কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। এই জায়গাগুলো আমার সবচেয়ে ভালো লাগার। শ্রীমঙ্গলে যখন পা রেখেছিলাম, তখন গোধূলিবেলা। বৃষ্টি হচ্ছিল। অনেকটা মেহেদিপাতার মতো চা–পাতার কাঁচা গন্ধ নাকে এসে লাগছিল। শ্রীমঙ্গল নাম শুনলেই সেই সুগন্ধ এখনো টের পাই। আর রাঙামাটি ভালো লাগার কারণ কাপ্তাই হ্রদ আর উঁচু–নিচু পাহাড়ি রাস্তা।

তিতলি, ক্যামেলিয়া এবং দুর্ভোগের রাত
ভোলার চরফ্যাশন থেকে লক্ষ্মীপুর যাত্রাটা জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। তখন ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। স্কুলের কাজ শেষে, দুপুরের খাওয়ার পর শরীরজুড়ে যখন আলসেমি জেঁকে বসেছিল, তখন তাগাদা পেলাম ফেরি ধরার। রাস্তায় নামতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি কিছুটা কমতেই আমরা আবার বাইকে উঠি। চিন্তা-ভয়-ঘূর্ণিঝড়—সব তুচ্ছ করে আমরা যখন ইলিশ ফেরিঘাটে পৌঁছালাম, তখনই দেখি ফেরিটা ঘাট থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। কয়েক মিনিটের জন্য ফেরিটা হাতছাড়া। উত্তাল নদীর তীরে চায়ের দোকানে পরবর্তী ফেরির জন্য অপেক্ষা ছাড়া করার কিছুই ছিল না।

দুই ঘণ্টা পর পরবর্তী ফেরি ক্যামেলিয়া এল। সাড়ে আটটার দিকে ফেরি ছাড়ল। পুরো ফেরিতে নারী বলতে আমরা চারজন। আমাদের সঙ্গে এযাত্রায় ছিলেন আরও দুজন। নদী এতটাই উত্তাল যে সমুদ্রের মতো মনে হচ্ছিল। শেষমেশ আমরা যখন লক্ষ্মীপুর পৌঁছলাম, তখন রাত ১১টা। কাদাপানি বিধ্বস্ত ফেরিঘাটের রাস্তা পেরিয়ে যখন প্রধান সড়কে উঠলাম, তখন সত্যিকার অর্থেই কোথাও কেউ নেই।

বেডি মাইনসে গাড়ি চালায়!
আমাদের যাত্রায় পথে পথে কটুবাক্য শুনতে হয়েছে, তবে বেশি শুনেছি স্তুতিবাক্যই। একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। নড়াইল থেকে যশোর যাচ্ছিলাম। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্কুটিতে ছুটছি আমরা। এমন আচমকা মুহূর্তে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একজন মধ্যবয়সী নারীর পাশ কাটাতেই বাতাসে ভেসে এল, ‘বেডি মাইনসে গাড়ি চালায়’! চালকের আসনে ছিলাম বলে তাঁর দিকে তাকানো হয়নি। কিন্তু তাঁর অবিশ্বাস্য মুখ–চোখের সামনে কল্পনা করতে পারছিলাম, নারীও যে মোটরবাইক চালাতে পারে, তিনি হয়তো নিজের চোখে কখনো দেখেননি।