মুজিববর্ষের প্রথম প্রকাশনা ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’

মোহাম্মদ ইফতিয়ারঃ

কৃষি পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ ও কৃষকদের জন্য সংগ্রামের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখিয়ে একটি স্বাধীন দেশও এনেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি ছিল কৃষি ও কৃষক। কৃষি ও কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বোপরি বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলে সোনার বাংলাদেশ সফল করার জন্য বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন বিভিন্ন পদক্ষেপ।

এসব বিষয় লেখক ড. শামসুল আলম তুলে ধরেছেন তার ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’ বইয়ে। বইটি মর্যাদা পাচ্ছে মুজিববর্ষের প্রথম প্রকাশনা হিসেবে। গত ১০ জানুয়ারি বইটির মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে৷

ড. শামসুল আলম কৃষি অর্থনীতিতে এমএসসি অধ্যয়ন করেন, কৃষি আর কৃষক নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। সে সূত্রে কৃষি ও কৃষক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ভাবনা জানতে পেরে অভিভূত হয়েই বইখানা লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।

এই বইটিতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা ও বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কৃষির জন্য কি কি করেছেন তার একটা সুন্দর বর্ণনা তুলে ধরেছেন লেখক। এতে বিষয়গুলো আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যেসব প্রবন্ধের মাধ্যমে এগুলো তুলে ধরেছেন তা হলো ’আজকের কৃষির যে ভিত্তি’, ‘মহাপুরুষের আবির্ভাব’, ‘সংবিধানে কৃষকের কথা’, ’স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর পদার্পণ’, ’বঙ্গবন্ধু, বিশ্বব্যাংক ও শিল্পায়ন’ ইত্যাদি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর, উন্নত সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই ভূখণ্ডকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু করলেন। দেখলেন কৃষির উন্নতি ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। তিনি জানতেন মানুষের প্রথম চাহিদা খাদ্য। আর খাদ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তিনি কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কৃষি উন্নয়ন বলতে বোঝায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশকে কৃষি অর্থনীতিতে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন।বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন কৃষি ও কৃষকের উন্নতি বিধান নিশ্চিত করা না গেলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।তিনি স্বপ্ন দেখতেন কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে। এ জন্য তিনি উচ্চতর শিক্ষা গবেষণা প্রশিক্ষণ এবং শহরের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। জাতীয় বৈদেশিক নীতির জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার পরিপ্রেক্ষিতগুলো ছিল-
১. বঙ্গবন্ধু কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। এ কারণে খাজনা দেওয়ার অক্ষমতা ও জটিলতা হতে মুক্ত হয়ে কৃষকরা আনন্দে কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু আমলে খাজনা আদায় থেকে সহজেই মুক্ত হয়েছিলেন।
২. অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম উপায় সম্পদের সুষম বণ্টন । বঙ্গবন্ধু সম্পদের সুষম বণ্টনে উৎসাহিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এক ব্যক্তির নামে ১০০ বিঘার উপরে জমি থাকাতে নিরুৎসাহিত করেছেন। অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টন করে ভূমিহীনদের চাষাবাদ করার সুযোগ তৈরি করে দেন। এভাবে কৃষি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছেন। পুঁজিবাদী সাম্যব্যবস্থা নিরুৎসাহিত করেছেন।
৩. গ্রাম্যসমাজ ভিত্তিক গরিব কৃষকদের সহযোগিতার জন্য সদ্য মুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
৪. স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রায় ২২ লাখের বেশি পরিবারকে পুনর্বাসন করেছিলেন।
৫. কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে তিনি প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেন। বাজেটে ভর্তুকি দিয়ে বিনামূল্যে কীটনাশক ও সার সরবরাহ করেন। ফলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে কৃষি উৎপাদন অতীতের যেকোনো সময় থেকে অনেক বেশি উৎপাদিত হয়েছিল। ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মী নিয়োগ করেছিলেন ।
৬. কৃষিপণ্য বিশেষ করে ধান, পাট, তামাক আখের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ন্যূনতম ন্যায্য মূল্য বেধে দিয়েছিলেন। গরিব কৃষকদের রেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সবুজ বিপ্লব কর্মসূচির আওতায় খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

‘বঙ্গবন্ধু, বিশ্বব্যাংক ও শিল্পায়ন’ প্রবন্ধে দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু বলেছেন শ্মশান হওয়া বাংলাকে তিনি সোনার বাংলায় গড়ে তুলতে চান। ফলে বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ২১ দফার প্রতিটা দফাই ছিল কোনো না কোনোভাবে কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলকামি। কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বন্যা ও খরার হাত থেকে কৃষককে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সরকারি ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করেন।

ড. শামসুল আলম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কৃষি সম্পর্কিত নানা তথ্য উপাত্ত সহকারে লিখেছেন ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থটি। এতে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি তাইতো বারবার বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষণকে টেনে এনেছে।’ এই বাংলার মাটি বাংলাদেশের মাটি, যদি সোনার চেয়ে খাটি না হতো তাহলে এতদিন আমাদের পরাধীন থাকতে হতো না।’

‘তিনি আরো বলেন বাংলার মাটি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই মাটিতে সোনালি ফসল ফলিয়ে সোনার বাংলা তৈরি করা সম্ভব। কৃষি বিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন ‘আমাদের গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে, কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। অধিক শস্য উৎপাদন করার জন্য মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। সমবায় ভিত্তিতে কাজ করে দেখাতে হবে।শহরমুখী রাজনীতির কথা ভুলে যেতে বলেছিলেন।’
‘তিনি বলেছিলেন, আমরা এখন গ্রামের দিকে যাচ্ছি। তখন আপনাদের দাম অনেক বেড়ে যাবে। শহরের ভদ্রলোকেরা দেখি আপনাদের চিন্তার কোন কারণ নাই। কারণ গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে যেতে হবে, কৃষককে বাঁচাতে হবে, উৎপাদন করতে হবে, তা না হলে বাংলাকে বাঁচাতে পারবো না।’

বঙ্গবন্ধু দেশকে ভালোবেসে কৃষিকে ভালোবেসেছিলেন, কৃষককে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু কালোরাত্রির পরে বিভিন্ন সময় দেশের চালিকাশক্তি স্বাধীনতাবিরোধীদের খপ্পরে চলে যাওয়ায় নতুন প্রজন্ম তাঁকে চিনতে পারেনি। কাজেই এই প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করানো উচিত। আর এ কাজের এক নতুন দ্বার উন্মোচন করল ড. শামসুল আলমের ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থটি।