করোনা চ্যালেঞ্জ; লকডাউনে থমকে যেতে পারে কোটি শ্রমিকের জীবন

মুমিন মাসুদ


করোনা আতঙ্কে ভুগছে পুরো বিশ্ব। ছোট্ট পরিসর থেকে ধিরে ধিরে মহামারি আকার ধারণ করেছে বহুল পরিচিত এই ভাইরাসটি। করোনা ভাইরাসের নাম শোনেনি এমন কেউ নেই বর্তমান বিশ্বে। প্রথম বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের বিভিন্ন রাজ্য/শহর লকডাউন করেও পার পাচ্ছেনা করোনার মৃত্যু থাবা থেকে। প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে ইতালি, স্পেন ও ইরানের মতো দেশগুলোতে।

বাংলাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত কিছু রোগী পাওয়া গেলেও গণমৃত্যু থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছি আমরা। এখনো অবস্থা খুব একটা খারাপ নয়। এখনি বাংলাদেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সংকল্পবদ্ধ না হলে ধারণা করা যায় মৃতের সংখ্যা ৬ থেকে ৭ ডিজিটের ঘরে পৌঁছতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধ একটি চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।


বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৭ লাখ। এ শ্রমশক্তির মধ্যে ৫ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। বাকি ২৭ লাখ বেকার। কাগজে-কলমে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছালেও সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ২ কোটির বেশি নারী-পুরুষ কৃষির সঙ্গেই যুক্ত। শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২ লাখ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা এখন প্রায় ৮৫ লাখ। রিকশা–ভ্যানসহ পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক।

নির্মাণশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ (প্রথম আলো, ০৩.০৫.২০১৭)। এই জনশক্তির সাহায্যে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে প্রতিনিয়ত। লকডাউনের মতো ঘোষণায় থমকে গেছে তাদের জীবন। তাদের আয়-উপার্জনহীন অবস্থা উত্তরণে করণীয় ঠিক করাই এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার কী নিজেকে এহেন অবস্থা মোকাবেলায় প্রস্তুত করেছে?

বাংলাদেশের জন্যে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো সাক্ষরতার হার। শুধুমাত্র জে.এস.সি বা এস.এস.সি পাশের হার অনুযায়ী সাক্ষরতা পরিমাপ করা হলে ভুল হবে। সরকারি নির্দেশে কিভাবে তাদের পরীক্ষায় পাশ করানো হয় তা স্কুলের শিক্ষকগণ জানেন। ২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরের ডেইলি স্টার থেকে জানা যায় বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার এক দশকে ২৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

কিন্তু, শুধু ঠেলাপাশ করা সাক্ষরতার হার দিয়ে মহামারি মোকাবেলার ক্ষেত্রে জনগণ থেকে আদিষ্ট আচরণ আশা করাটা সরকারের বোকামী হবে। চীনে যখনই এই ভাইরাসটি আত্মপ্রকাশ করে তখন অতি সচেতন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ ভাইরাসের নামও জানতোনা। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষকে কোয়ারেন্টাইন কী জিনিস, কীভাবে পালন করতে হয় তা বুঝানো মুশকিল। স্পষ্ট ধারণা না থাকায় করোনা ভাইরাসটি বাঙ্গালীর কতোটা বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু স্ক্রল করলেই বুঝা যায়।


বাংলাদেশের তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো সমাবেশ রোধ। আমরা জাতি হিসেবে খুব একটা সভ্য নই। জাতির একটি বিরাট অংশ পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। নতুনত্বকে গ্রহণ করার মানসিকতা ও ধারণক্ষমতার কোনটাই এই জাতির নেই। করোনা ভাইরাসটি এমনিতেই গতিশীল। যদি কোন সভা-সমাবেশে একবার ছড়িয়ে পড়তে পারে, তবে দেশের সাধ্য নেই তা রোধ করার। তাই সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং বন্ধ করা খুবই প্রয়োজন।

জার্মানিতে ২ জনের বেশী লোক রাস্তায় একসাথে হাঁটলে, গল্প করলে বা সমাগম হলেই জরিমানা গুনতে হচ্ছে। বাঙ্গালির যেখানে বিকেল বেলা লুঙ্গি কাঁছা দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পান জাবর না কাটলে দিন মাটি হয়ে যায়- সেখানে সভা-সমাবেশ রোধ করাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি বন্ধের ঘোষণা থাকলেও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা সকল নিয়ম ভঙ্গ হতে দেখেছি। যিনি ক’দিন পরেই দায়িত্ব নিবেন নগরপালের, তার আচরণ যদি এমন হয় তবে সাধারণ মানুষ কী মেসেজ পেতে পারে?


আমার দেশের মন্ত্রী আমলারা কথা বলার ফুরসত পেলেই কেমন জানি বিগড়ে যান। তাদের মুখনিঃসৃত বুলিগুলো মানুষের হাসি-মজাখের খোরাক হয়ে যায়। তাদের মুখে এমন উদ্ভট সব কথাবার্তা প্রকাশ পায় যে দেখলে বুঝতে কষ্ট হয়না তারা নিজেরা কতটা ভিত-বিহ্বল। জনগণকে সাহস দেওয়ার পরিবর্তে মিথ্যে তথ্য ও গাঁজাখুরি কথাবার্তায় বিদ্বেশ ছড়াচ্ছেন বেশি। সাধারণ জনগণের মনে সরকারকে কেন্দ্র করে একটি নেগেটিভিটি বলয় তৈরি হচ্ছে। মানুষের সাথে সরকারের এমন দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে- যা কখনোই কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকের কাম্য নয়। সরকারের করোনা প্রতিরোধের চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হলো এসব অযোগ্য ও অপদার্থ মন্ত্রী-আমলাদের বর্জন করা। দেশের যেকোন ইমার্জেন্সি ক্রাইসিসে তাদেরকে জনগণের পালস বুঝতে হবে। জনবিচ্ছিন্নভাবে কোন মহামারি প্রতিরোধ করা যায়না।


বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলায় যথেষ্ঠ পরিমাণে টেস্ট কিট ও ডাক্তারদের জন্য পিপিই নেই। যার ফলে রোগীদের অধিকাংশ রোগ শনাক্ত করা যাচ্ছে না। নিউমোনিয়া ভেবে টেস্ট না করে ফেলে রাখছে। আরো বড় অজ্ঞতার পরিচয় হলো বিদেশ ফেরত কারো সংস্পর্শে না এলে বা ভিকটিম নিজে বিদেশ ফেরত না হলে আইইডিসিআর তার করোনা টেস্ট করছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও ভূটান আমাদের থেকে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল হলেও একটি মহামারি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গৃহিত ব্যবস্থার জন্যে তাদের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।

চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হওয়া সত্বেও করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে তারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিম উদ্যোগ নিয়েছে। মানুষকে লকডাউনে রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ-ই করোনা প্রতিরোধের মূল বাধা। মহামারির কথা শোনেই বাজার অনিয়ন্ত্রিত, মূল্য লাগামহীন, পণ্যের কৃত্রিম সংকট ও ভেজাল পণ্যের মাত্রাতিরিক্ত বাজারজাতকরণ রোধ করা যায়নি। ভোক্তা অধিদপ্তর কিছুটা হাল ধরলেও নিম্নবিত্তের নিকট মূল্য এখনো লাগামহীন রয়ে গেছে।


এই দীর্ঘ হওয়া চ্যালেঞ্জিং পয়েন্টগুলোর মধ্যরেখায় দাঁড়িয়ে একটি দেশের উচিত তার গুণগত মান বৃদ্ধি করা। শুধু কাঠামোগত উন্নয়ন দিয়েই দেশের উন্নতি পরিমাপ করা যায়না। এই দু’য়ের সমন্বয়েই তৈরি হতে পারে একটি জাতি ও তার সভ্যতা। যতদিন এই গুণগত চিন্তা-চেতনার বিকাশ সাধনের পথ দীর্ঘ হতে থাকবে, ততদিন আমরাও জাতি হিসেবে লকডাউনের সময় বাস-কাউন্টারে ভিড় করতে থাকবো। আর মহামারি বারবারই আসবে।

লেখক: সাবেক সহসভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি