অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে যুবক, অতপর!

বাংলা বার্তা ডেস্কঃ

সকালে বাংলামোটরস্থ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অফিসের উদ্দেশ্যে রামপুরা ব্রিজ থেকে স্বাধীন বাসে উঠেছি। সামনে সিট না থাকায় একদম পেছনের সিটে বসতে হলো। আমার এক সিট সামনে থাকা লোকটিকে হেলপার বারবার ভাড়া দিতে বলছিল কিন্তু লোকটি ঘুমাচ্ছে। দ্বিতীয় বার এসে বেশ ক’বার ডাকল। কিন্তু তখনও লোকটি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তৃতীয় বার এসে ডাকাডাকি করার পর কোনো সাড়া শব্দ না পাওয়ায় আমার সন্দেহ হলো। পাশাপাশি থাকা অন্যদেরও। যাত্রীরা সবাই মিলে ডাকলাম। কোন সাড়া না পেয়ে নিশ্চিত হলাম অজ্ঞান পার্টির শিকার হয়েছে লোকটি। মুখ দিয়ে কিছুটা লালা বের হচ্ছে। একজন মহিলা যাত্রীর কাছ থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে দিলাম কিন্তু কোন কাজ হলো না। চেতনাহীনভাবেই পড়ে রইল। যাত্রীদের একজন বলল কি আর করার, নামিয়ে দেওয়ার দরকার নাই। নামানোর অবস্থাও নাই। সিটেই শুয়ে থাকুক। ঘোর কেটে গেলে কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া, গাড়ি তো মোহাম্মদপুর ঘুরে থেকে ঘুরে ফের এদিকেই আসবে। এর মধ্যে যদি জ্ঞান ফিরে নেমে যাবে। তখন আমরা মালিবাগ পার হয়ে মৌচাক সিগন্যাল পার হচ্ছি।

কিন্তু লোকটির স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার বা ঠিক হয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ আমার চোখে পড়ল না। কারণ নানা সময় এরকম ঘটনায় গণমাধ্যম সূত্রে জেনেছি অজ্ঞান পার্টির লোকজন হাই-ডোজের চেতনাশক ব্যবহার করে। তাছাড়া, এভাবে একজন মানুষ পড়ে থাকবে তা হয় নাকি। বিলেত প্রবাসী এক বোনকে পাঠাবো বলে আমার সঙ্গে থাকা একটা ছোটখাটো লাগেজ, দুপুরের খাবারসহ অফিস ব্যাগ। তবুও ভাবলাম লোকটাকে সহযোগিতা করা দরকার। মগবাজার সিগন্যাল পার হয়ে যাত্রীদের বললাম ভাই কেউ একটু আমাকে সহযোগিতা করেন। ঠিক অফিসগামী বাবু শ্রেণির কেউ না, মোতালেব প্লাজায় মোবাইলের দোকানে কাজ করেন নামেই শুধু বাবু এমন একজন তরুণ এগিয়ে এলেন। চেতনাহীন লোকটির সঙ্গে ফুলকলি কোম্পানির একটি ব্যাগ। সবার সামনে ব্যাগের মধ্যে খুঁজে কিছু অর্ডারের কাগজপত্র আর দুইটা মোবাইল ফোনও পাওয়া গেল। ফোন নিয়ে যায় নি দেখে আমরা বেশ অবাক হলাম। ডায়াল নাম্বার চেক করে ‘বউ’ লেখা দেখে গ্রামে থাকা উনার স্ত্রী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকে ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানালাম। একজন আত্মীয় বলল কাঁচপুর ব্রিজ এলাকা থেকে আসতেছে। লোকটাকে ধরে বাংলামোটর হোমটাউন এসি মার্কেটের সামনে নামিয়ে সিঁড়িতে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসালাম। স্বাধীন বাস(ঢাকা মেট্রো-ব, ১১-৯৪৬৩) থেকে নেমেই সহযোগিতার জন্য আমার এক সহকর্মী রিপন আহসান ঋতুকেও ডাকলাম। আশেপাশে দোকানে থাকা লোকজনও এগিয়ে এলো। লোকটার আত্মীয় স্বজনের নাম্বারে আবার ফোন দিয়ে জানলাম বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান। নাম আবদূর রব। ফুলকলির নামাঙ্কিত ব্যাগ থেকে দেখে অফিস নাম্বারেও ফোন দিলাম। জানলাম উনি এস আর হিসেবে ফুলকলিতে কাজ করে।

আত্মীয় স্বজনের আসতে দেরী হবে দেখে জরুরী সেবা নাম্বার ৯৯৯ ফোন দিলাম। সংশ্লিষ্ট রমনা থানা পুলিশকেও ব্যাপারটা জানানো জরুরী বলে মনে করলাম। ৯৯৯ এর মাধ্যমে থানায় যোগাযোগ করিয়ে দিল ওরা। বেশ অভিভূত হলাম ফোন দেওয়ার মাত্র ৯ মিনিটের মাথায় অফিসার দুলাল(এস আই) সাহেবের নেতৃত্বে পুলিশের একটি গাড়ি এসে হোম টাউন এসি মার্কেটের সামনে হাজির । তাদের সহযোগিতায় দ্রুত লোকটিকে ঢাকা মেডিকেলের ইর্মাজেন্সিতে পাঠানো হল। সঙ্গে থাকা দুইটা ফোন ও ব্যাগ পুলিশ অফিসারকে বুঝিয়ে দিলাম। বেলা দুইটার দিকে এস আই দুলাল সাহেবকে ফোন দিয়ে জানলাম আত্মীয় স্বজন এসেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ওয়াশ করা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি আছে। ডাক্তার বলেছেন, বিকেলের দিকে অবস্থা জানা যাবে। জরুরী সেবা নাম্বার ৯৯৯ ফোন দেওয়ার এই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এত তড়িৎ রেসপন্স দেখে আমি সত্যি আশ্চর্য হয়েছি। অভিভূত হয়েছি। সিলেট অঞ্চলে বাড়ি হওয়ায় এমন জরুরী সেবার গল্প এক সময় বিলেতে প্রবাসী আত্মীয় স্বজনদের কাছেই শুধু শুনতাম।

যা হোক, পুলিশ ডাকতে উপস্থিত কেউ কেউ আমাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন কিন্তু এরকম ঘটনায় অবশ্যই পুলিশকে জানানো উচিত। পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া উচিত। আর এরকম পরিস্থিতিতে অযথা উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কি বলে কেউ এড়িয়ে যাবেন না। এরকম দুর্ঘটনা ও পরিস্থিতির শিকার আপনি আমি যে কেউ যে কোনও জায়গায় যে কোন সময় হতে পারি। আমার কাজ আছে, ব্যস্ততা আছে, সহযোগিতা করলে বিপদে পড়তে হয় বলে সবাই এড়িয়ে গেলে এমন এক দিন আসবে কেউ কারো পাশে দাঁড়াবে না। আপনিও মরে পড়ে থাকবেন উদ্ধারের জন্য কাউকে পাবেন না। বিপদে আপদে অবশ্যই সব ভুলে সর্বাগ্রে মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আমি এক সামান্য অধম সকলের সহযোগিতায় বিপদগ্রস্ত একজন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। বাসে উঠলে সতর্ক থাকুন। পাশে বসা যাত্রীকে একবার পরখ করে নিন। কিছুটা দূরযাত্রা হলে এবং ঘুম পেলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন। ভূপেন হাজারিকার ভূবন বিখ্যাত গানটা দিয়ে আজকের এ অভিজ্ঞতা লেখা শেষ করি, “মানুষ মানুষের জন্য। জীবন জীবনের জন্য।” সমাজটা মানুষের হোক। দস্যু ও দানবের না।