নিজস্ব প্রতিবদক: কোনও গেজেট নেই, নেই জনবল মঞ্জুরিও। তারপরেও চলছে রেলওয়ে ক্যাটারিং সেল। যার সুবাদে সরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা অবৈধ পথে অর্জন করছেন রেলওয়ের গুটিকয়েক কর্মকর্তা। সরকার কোন রাজস্ব তো পাচ্ছেই না, উল্টো বিশাল অংকের অর্থ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন পাঁচটিতে রেলওয়ে ক্যাটারিং ও ট্যুরিজম সেল গঠন করে ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। রেলওয়ের সাবেক উপ-পরিচালক (মার্কেটিং) কালিকান্ত ঘোষ এসব ব্যবসা পরিচালনা করেন।
জানা যায়, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেস,পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও বেনাপোল এক্সপ্রেস থেকে প্রতি মাসে যথাক্রমে ৪ লক্ষ টাকা, ৩ লক্ষ টাকা, ২ লক্ষ টাকা, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস থেকে ২ লক্ষ টাকা ও বেনাপোল এক্সপ্রেস থেকে ২ লক্ষ টাকা নিয়ে থাকেন কালিকান্ত ঘোষ। ৫টি ট্রেন থেকে মাসে নেন মোট ১৩ লক্ষ টাকা।
এক বছরে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকায়। এই বিশাল লভ্যাংশ থেকে কালীকান্ত ঘোষ বাংলাদেশ রেলওয়েকে প্রতি বছর লাইসেন্স ফি বাবদ ৪ লক্ষ টাকা দেন। বাকি টাকা আরও ৪-৫ জন ঊর্ধ্বতন কমর্কতাদের মধ্যে ভাগ করে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালীকান্ত ঘোষ এক বছর আগে অবসরে গেলেও সাবেক ডিজি ডি এন মজুমদারের ছত্রছায়ায় থেকে ‘রেলওয়ে ক্যাটারিং সেল’ নামে ক্যাটারিং ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। সাবেক ডিজি ডি এন মজুমদারকে প্রতি মাসে ২ লক্ষ টাকা দেন তিনি।
সূত্রমতে, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) জাহান মিয়াকে এই পাঁচটি গাড়ির আয় থেকে প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা প্রদান করেন কালীকান্ত ঘোষ। অবসর গ্রহনের পরও এই দুই কর্মকর্তা চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনার ক্যাটারিং কোম্পানি গঠন করার তৎপরতা চালাচ্ছে।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান, সাবেক উপ-পরিচালক (মার্কেটিং) কালিকান্ত ঘোষসহ আরো ৪-৫ জন কর্মকর্তা ক্যাটারিংয়ের পাশাপাশি গাড়িগুলোতে বেয়ারা নিয়োগ দেন। প্রতি বেয়ারা থেকে ১ লক্ষ টাকা করে নেন তারা।
বনলতা ট্রেনের ক্যাটারিং সেলের ম্যানেজার মোহাম্মদ জনি বলেন, ম্যানেজার নিয়োগের সময় আমাকে বলেছিল সরকারি চাকরি। এখন দেখি আজ আছি কাল নাই। পাঁচটি ট্রেনে ১২০ জন বেয়ারা আছে। প্রত্যেক বেয়ারা থেকে সরকারি চাকরি বলে এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা নিয়েছে তারা। আমার কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়। সকল ম্যানেজারকে মাসিক টার্গেট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
রেলওয়ের নিয়মিত যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ট্রেন পাঁচটিতে খুবই নিম্ন মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। রমজান মাস ছাড়া আর কোন সময়ে ভাত এবং বিরিয়ানী বিক্রির অনুমতি না থাকলেও ফুটপাত দোকান থেকে বিরিয়ানী ক্রয় করে নিম্নমানের খাবার বিক্রি করা হয় ট্রেনগুলোতে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির সদস্য মো. মকাররম জানান, সোনার বাংলা, বনলতা, কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের সার্ভিস খুব খারাপ। খাবারের মান খুবই নিম্নমানের।
রেল সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের একজন নিয়মিত যাত্রী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর মিয়া জাহানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে বছরে ৬ কোটি ২৫ লক্ষ ৪৪ হাজার সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের অনুলিপি রেল সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও প্রেরণ করেন তিনি। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির বলে সেই অভিযোগ তদন্তের মুখ দেখেনি।
দুদকে চিঠির জবাবে তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিয়া জাহান ও উপ-পরিচালক (মার্কেটিং) কালীকান্ত ঘোষ দাবি করেন, রেলওয়ের দাখিলকৃত ভাড়া দেওয়া ছাড়া এই ৫টি গাড়ি থেকে তারা অন্য কোন আয় করেন না।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে ক্যাটারিং সেল নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। ক্যাটারিং সেল গঠনের কোন গেজেট নাই। জনবল মঞ্জুরিও নাই। সরকারি চাকরিজীবিদের চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয়ের একটি পথ করে দিয়েছে এই সেবা। রেলওয়ের যে সকল কর্মকর্তা এই ক্যাটারিং সেলের সাথে জড়িত তাদের সম্পদের হিসাব নিলে বোঝা যাবে এরা কত টাকার মালিক হয়েছেন।
অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, পদ মঞ্জুরি না থাকায় সাবেক রেল সচিব সেলিম রেজাকে ম্যানেজ করে কালীকান্ত ঘোষ ও রশিদা সুলতানা গণি বাংলাদেশ রেলওয়ে ক্যাটারিং সেলকে ক্যাটারিং কোম্পানিতে রুপান্তর করে অবসরে যাওয়ার পরও চুক্তি ভিত্তিক চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের জন্য তদবির করেছিলেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনে পর্যটন কর্পোরেশন বিগত ৪ বছর সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করলেও রেলওয়ের ৫ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে পর্যটন কর্পোরেশনকে সার্ভিস চলমান রাখার মেয়াদ বৃদ্ধি করেননি। রেলওয়ে সাবেক যুগ্ন মহাপরিচালক (অপারেশন) রশিদা সুলতানা গণি, সাবেক উপ-পরিচালক (মার্কেটিং) কালিকান্ত ঘোষসহ আরও ৩ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে পর্যটন কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি নবায়ন করতে দেননি।
জানা যায়, রেলওয়ে সাবেক সচিব সেলিম রেজা একান্ত প্রচেষ্টায় পর্যটন কর্পোরেশনের চুক্তি নবায়নের জন্য বারবার সভা করলেও তা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে কালীকান্ত ঘোষের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। সাবেক ডিজি ডি এন মজুমদার ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অপারেশন মিয়া জাহানের সাথে বারবার যোগাযোগ করেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রেলের মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানান, আমি নতুন যোগদান করেছি। এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
অর্থ মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব জানান, সরকারী চাকরির বিধানের মধ্য কোন কর্মকর্তা অর্থ মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন ছাড়া ট্রেনে কোন খাবার বিক্রি করতে পারবে না, তা আইনত দন্ডনীয়। যারা এ ধরনের বিক্রি বা লেনদেনের অনুমতি দিবে তারাও একই ধরনের অপরাধী। এই বিষয়টি তদন্ত করলে বিভাগীয় মামলা পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ অডিট অধিদপ্তরের ডেপুটি ডাইরেক্টর জানান, রেলওয়ে ক্যাটারিং সেলের নামে কয়েকজন কর্মকর্তা সরকারী নিয়ম অমান্য করে এই কান্ড করছে। এই বিষয়টি অডিটের নজরে এসেছে, আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবো।
এসএস/বাংলাবার্তা