মহিউদ্দীন টিপুঃ
এক সময় চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে চাষিদের অন্যতম প্রধান আবাদ ছিল খেজুর রস। তাই শীতকালে ওদিকের জীবনযাত্রা ছিল খেজুর গাছ কেন্দ্রিক। হাটে মাঠে ঘাটে পথে সব জায়গায় সাজ সাজ রব ছিল এ মৌসুমে। শীতকালে হাটের আনাচে কানাচে ছেয়ে যেত গুড়ের লাল লাল ভাঁড়ে। চট্টগ্রাম সহ আশে পাশের পাইকারেরা আসত গুড় কিনতে। আড়তদারেরা বড় বড় পাল্লা বসিয়ে তাই বিকিকিনি করত। ছিল বড় বড় সব খেজুর বাগান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই গাছিরা দল বেঁধে বাঁশ-সরপার তৈরি ঠোঙা কাঁধে চলত মাঠপানে। এখন আগের মতো বড় বড় খেজুরবাগান আর নেই। রস-গুড়ের আবাদ বাদ দিয়ে অন্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা। তাই রস-গুড়ের সেই রমরমা যুগ ম্লান হয়ে গেছে। তবু কিছু কিছু খেজুরবাগান এখনো আছে। গাছিরাও এখনো গাছ কাটেন। এখনো ওসব এলাকায় শীতের সকাল ম-ম করে তাঁতরস আর গরম গুড়ে গন্ধে
শীতের কুয়াশামাখা সকালে কাঁধে কলসিভরা খেজুর রস বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন গাছি
শীতকালে দুপুরটা বড্ড ছোট। বেলার সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। তা ছাড়া বিকেলে হাট। গুড় বেচতে হবে। তার আগেই গাছ কাটা চাই। গাছিরা তাই দুপুরের ভাতটা কোনো রকমে নাকেমুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়েন মাঠে।
বাঁশ-সরপার তৈরি ঠোঙা নিয়ে খেজুরগাছ বাইতে চলেছেন এক গাছি
পিঠে বাঁশ আর খেজুরগাছের সরপা দিয়ে তৈরি ঠোঙা থাকে গাছির। সেই ঠোঙার ভেতর কয়েক রকমের দা, নলি, দড়ি, সুচালো কাঠি, গোঁজ ইত্যাদি থাকে। কোমরে বাঁধা একটা মোটা দড়ি। এই দড়ির সাহায্যেই গাছি নিজেকে গাছের সঙ্গে আটকে রাখেন। এ ছাড়া থাকে তালগাছের ফালি দিয়ে তৈরি বালিধারা। বালিধারার ওপর বালু দিয়ে দা ঘষা হয়। দা ধার করা বা শানানোর জন্য।
গাছির একজন সহযোগী থাকে। সে রসের ভাঁড়গুলো মুখোমুখি দুই সারিতে সাজায়। তারপর এর মাঝখানে গুঁজে দেয় খড়বিচালি। তারপর তাতে ধরিয়ে দেয় আগুন। আগের দিনের রসের গন্ধ ভাঁড়ের গায়ে লেগে থাকে। শুধু পানি দিয়ে ধুয়ে তা যায় না। কিন্তু আগুন দিয়ে এভাবে ভাঁড় পোড়ালে গন্ধটা চলে যায়।
এরপর গাছি ঠোঙাসহ গাছে চড়ে বসেন। মোটা দড়ি দিয়ে নিজেকে পেঁচিয়ে ফেলেন গাছের সঙ্গে।
তবে ব্যাপারটা মোটেও গাছের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলার মতো নয়। দড়িটা বেশ ঢিলে করে গাছ ও গাছি শরীরকে একটা বন্ধনীর ভেতর ঢুকিয়ে দেন। গাছি তাঁর দুই পা গাছের সঙ্গে ঠেকিয়ে নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দেন দড়ির ওপর। শক্ত দড়ির ঘর্ষণজনিত আঘাত থেকে বাঁচার জন্য গাছির কোমরে প্যাঁচানো থাকে পাটের বস্তা। এরপর শুরু গাছ কাটা।
শীতের শুরুতেই গাছের মাথার এক পাশের পাতা ও সরপা পরিষ্কার করে ফেলা হয়। তারপর সেখানে দা দিয়ে চেঁছে মানুষের চোখের আদলে দুটো চোখের মতো তৈরি করা হয়। দুই গর্তের নিচে নাক বরাবর বসিয়ে দেওয়া হয় বাঁশের নলি। নলির ঠিক নিচে গাছের গায়ে তির্যকভাবে পোঁতা হয় বাঁশের গোঁজ। এই গোঁজ পেরেকের মতো কাজ করে। গোঁজের সঙ্গে দড়ির সাহায্যে আটকে দেওয়া হয় কলসি। যশোর-কুষ্টিয়া এলাকায় রসের কলসিকে ভাঁড় বলে।
দুদিন পরপর সেই চোখের ওপর ধারালো দা দিয়ে চাঁছেন গাছি। চাঁছার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের নলি বেয়ে ঝরতে শুরু করে রস। বাঁশের এই নলিগুলো সব সময় গাছে লাগানো থাকে। কোনো কারণে নলি নষ্ট হয়ে গেলে গাছি ঠোঙা থেকে নতুন নলি বের করে সেখানে লাগায়। এরপর গাছি সদ্য কাটা চোখগুলো বাঁশের সুচালো এক কাঠির সাহায্যে ভালো করে ঘষে ঘষে রস পড়ার রাস্তাটা পরিষ্কার করে। ফলে খুব সহজেই রস নলিতে পৌঁছাতে পারে।
গাছকাটা শেষে গাছি সেই গাছ ছেড়ে অন্য গাছ কাটতে চলে যায়। গাছির সহযোগী এসে সদ্য কাটা গাছের গোঁজে ভাঁড় আটকে দেয়। সহযোগী না থাকলে গাছির খাটুনি একটু বেশি হয়।
এরপর বিকেল-সন্ধ্যা-রাত মিলিয়ে প্রায় পনেরো ঘণ্টা নলি বেয়ে রস পড়ে ভাঁড়ে। তবু সারা রাতে এক ভাঁড় রস পাওয়া যায় না একটা গাছ থেকে। দু-তিন গাছ মিলিয়ে এক ভাঁড় রস হয়।
ভোরে উঠে গাছিরা মাঠে চলে যান। তখন ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকে প্রকৃতি। গাছির পিঠে থাকে বাঁক। বাঁক হলো চেরা বাঁশের তৈরি একধরনের লাঠি। এর দুই মাথায় দুটো আংটা থাকে। সেই আংটায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো হয় রসের ভাঁড়। বাঁকের দুপাশে সমানসংখ্যক ভাঁড় ঝোলানো হয়। তাতে দাঁড়িপাল্লার মতো ভারসাম্য তৈরি হয়। ভাঁড় বহন করতে সুবিধা হয় এতে। কখনো কখনো ভাঁড়ের সংখ্যা অনেক বেশি। তখন রসের ভারে বেঁকে যায় বাঁক, বেঁকে যায় গাছির শরীর।
গাছিদের বাড়িতে রস জ্বালানোর জন্য ইট ও মাটির তৈরি বড় একটা চুলা থাকে। এ ধরনের চুলাকে বলে বাইন। এখানকার বাইনগুলো আয়তাকার। আগেকার বাইনগুলো ছিল গোলাকার। কারণ, এ যুগে গুড় জ্বালানো হয় আয়তাকার টিনের পাত্রে। আগেকার দিনে গুড় জ্বালানো হতো গোলাকার মাটির হাঁড়িতে। রস জ্বালানো হাঁড়িকে জ্বালা হাঁড়ি বলে। জ্বালা হাঁড়িতে রস ঢালার পর চুলায় আগুন দেওয়া হয়।
এখনকার বাইনের দুই দিকে দুটো বড় ছিদ্র থাকে। একদিক থেকে জ্বালানি ঢোকানো হয়। অন্য দিক থেকে জ্বালানি পোড়া কয়লা বেরিয়ে বাইনের ভেতরের জায়গাটা পরিষ্কার রাখে। বাইরের দুই পাশে তিনটা করে মোট ছয়টা জানালা থাকে। অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখা ও ভেতর থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করার সুবিধার্থে এ ব্যবস্থা।
রস জ্বালাতে দরকার হয় প্রচুর জ্বালানি। এ জ্বালানির বেশির ভাগটাই জোগান দেয় খেজুরগাছ। মৌসুমের শুরুতেই গাছ কাটার উপযোগী করতে ছেঁটে ফেলতে হয় প্রচুর খেজুরপাতা। সেই পাতাগুলোই শুকিয়ে রস জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া মাঠের ঝোপজঙ্গল কেটে শুকিয়েও রস জ্বাল দেওয়া হয়। অনেক সময় ব্যবহার করা হয় খড়বিচালিও ।
জ্বালা হাঁড়িতে রস ঢালার আধঘণ্টা পর ফুটতে শুরু করে। জ্বালা হাঁড়ির ওপর তখন ঘন কুয়াশার মতো জলীয় বাষ্প দেখা যায়। গুড় জ্বালানো দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রায় তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। মাঝে মাঝে রসের ভেতরে থাকা ময়লা একত্র হয়ে সাদা ফেনা জমে। উড়কি মালা দিয়ে ফেনা ফেলে দেন গাছি।
ঘণ্টা দুয়েক পর রস অনেকটা লাল হয়ে ওঠে। চারদিকে সুবাস ছড়ায়। সারা গ্রামের বাতাস তখন ভরে ওঠে মিষ্টি গন্ধে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে উড়কিমালা দিয়ে খানিকটা তাঁতরস তুলে নেয় গ্লাসে। ফুঁ দিয়ে চায়ের মতো করে খায় তাঁতরস। ঘণ্টা তিনেক পরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রস পুরোপুরি লাল হয়ে ওঠে। গুড় নামানোর জোগাড়-যন্ত্র করেন গাছি কিংবা গাছি-বউ। গুড় নামানো হয়। গন্ধটা তখন আরও মিষ্টি হয়।
উড়কিমালা দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়া হয় গরম গুড়। এরপর আসল কাজ। ‘বীজ মারা’। জ্বালা হাঁড়ির গায়ে খেজুরপাতার ডাঁটা ঘষে ঘষে বীজ মারা হয়। এর ফলে হাঁড়ির গায়ে সাদাটে পেস্ট তৈরি হয়। বীজ মারার ওপরই নির্ভর করে গুড়ের মান। বীজ মারা যত ভালো হবে, গুড়ও তত ঘন হবে। গুড় জমিয়ে পাটালি করতে হলে অনেক বেশি সময় ধরে বীজ মারতে হয়। মেঘলা দিনে শত চেষ্টা করেও বীজ মেরে পেস্ট তৈরি সম্ভব নয়। তাই মেঘলা দিনে একেবারে ঝোলা গুড় ছাড়া জমাট গুড় পাওয়া অসম্ভব। বীজ মারা শেষ হলে উড়কিমালা দিয়ে সাদা পেস্ট গুড়ের সঙ্গে মেশানো করা হয়। এ সময় ছেলেমেয়েরা বাঁশের কাঠি কিংবা শুকনো খেজুরপাতা ভাঁজ করে তা দিয়ে হাঁড়ি থেকে গুড় তুলে খায়।
সবশেষে গুড় ঢালা হয় মাটির ভাঁড়ে। এরপর ভাঁড়ের মুখটা ঘন জমাট গুড় দিয়ে বন্ধ করা হয়। তারপর গুড়সহ সেই ভাঁড় চলে যায় হাটে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।