এম এ হাসান
আজ সমস্ত পৃথিবীর চিত্র ইয়েমেন ও সিরিয়ার যুদ্ধ ক্ষেত্রের মত। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেমন নিজেকে বাঁচানোর জন্য সবাই আত্ম-রক্ষায় ব্যস্ত থাকে, সমস্ত পৃথিবীর চিত্রও তাই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য শুরু থেকে কাজ করার সুবাদে মানুষের অসহায়ত্ব দেখেছি নিজের চোখে। এক মুঠো খাবারের জন্য তাদের দিক-বেদিক পাগলের মতো ছুটাছুটি করতে দেখেছি আহত অবস্হায়, দেখেছি চিকিৎসাবিহীন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকতে, দেখেছি শরণার্থী মাকে খোলা আকাশের নিচে সন্তানের জন্ম দিতে। সেই দিন তাদের কান্না কেউ দেখেনি। ঠিক একই ভাবে আজ পৃথিবীর মানুষ ক্রন্দনরত। করোনা আক্রান্ত রোগীর পাশে যেতে চাই না ডাক্তার কিংবা তার নিজের আত্নীয় স্বজনেরা ।
অসহায়ের মত পড়ে আছে হাজার হাজার রোগী। যুদ্ধ ক্ষেত্র যেমন লাশের পর লাশ পড়ে থাকে, হাজার হাজার আহত রোগী পড়ে থাকে বিনা চিকিৎসায়, মানুষ নিজেকে বাঁচাতে পলায়নরত থাকে, আজ পৃথিবীর চিত্রও ঠিক তাই। সবাই নিজেকে বাঁচাতে পলায়নরত।
দেশে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের সময় দেখা যেত,তারা হোমকোয়ারেন্টাইনের মত বাসায় বন্ধি থাকত, বাইরে আক্রমণের ভয়ে পা রাখতে পারতনা, ঠিক একইভাবে করোনা মানুষকে এখন বন্ধি করে রেখেছে। দুর্বলের উপর সবলের নির্যাতন ও মানসিক কষ্টের বহি:প্রকাশ নিয়ে এসেছে, এটি মানুষের জন্য একটি শিক্ষণীয় বার্তাও বটে।
হয়তো পৃথিবীর এমন অসহায়ত্ব মানুষ আগে কখনো দেখে নি, সামনেও হয়তো দেখবে না। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর পারমানবিক বোমার কিংবা অস্ত্রের ঝনঝনানি, মানুষের দাম্ভিকতা আজ নিজের বেড রুমে বন্ধি । বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পৃথিবীর নীতি নির্ধারক সবাই একে অপরে দিকে থাকিয়ে আছে অসহায়ের মত। থাকিয়ে আছে সমাধানের খোঁজে, যেভাবে থাকিয়ে থাকতো যুদ্ধ বিধস্হ অসহায় রাষ্ট্রের মানুষ গুলো। তারা মনে করতো পৃথিবীর কোন দেবতা রাষ্ট্র তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে, তাদের সমস্যার সমধান বা মুক্তি দিবে। আজ উন্নত রাষ্ট্রগুলোও ঠিক একই ভাবে থাকিয়ে আছে একে অপরে দিকে। তারা মনে করছে হয়তো কেউ এসে তাদের মুক্তি দিবে, একটি প্রতিষেধক কিংবা ভ্যাক্সিন বানিয়ে দিবে। দুইটায় যেন সমান যুদ্ধ ক্ষেত্র।
ছোটকাল থেকে আমার কাছে কেমন যেন মনে হত পৃথিবীর যুদ্ধ গুলো কোন না কোন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসার জন্য কৃত্রিম ভাবে তৈরী। ঠিক যেমনটা কোন কোম্পানির একচেটিয়া ভাবে কোন পণ্যের বাজার দখল করার মতো। তারা অস্ত্র তুলে দিতো নিজের তৈরী সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে, তাদের পৃষ্টপোষকতা শুরু করতো, পরে তাদের মোকাবেলায় রাষ্ট্র সমূহকে বাধ্যতামূলক ভাবে অস্ত্র কিনতে হতো ক্ষমতাশীল রাষ্ট্র গুলোর কাছ থেকে। এভাবে ক্ষমতাশীল রাষ্ট্র গুলো নিজেদের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে নিত। অপর দিকে জীবন দিতে হয়েছিল হাজার হাজার নিরহ মানুষদের। অাজ ঠিক একই ভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিরাপত্তার পণ্য তৈরী করে নিজেদের অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছে বেশ কয়েকটি দেশ।
নিশ্চয় আমাদের সবার আইলান কুর্দির কথা মনে আছে। পাঁচ বছরের ছোট শিশু। যার নিতর দেহ পড়ে ছিল তুরস্কের উপকূলে। সিরিয়া থেকে গ্রিস যাওয়ার পথে নৌকা ডুবিতে মারা গিয়েছিল। এই নিষ্পাপ শিশুর মর্মস্পর্শী ছবি যা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। ছবিটি যেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির নেতিবাচক প্রভাবের জলজ্যান্ত উদাহরণ। অার অাজ সেই মর্মস্পর্শী চিত্র নিজ চোখে ভেসে উঠছে, যখন দেখা যায় কোন শিশু করোনায় আক্রান্ত তখন অসহায় পিতা মাতা সেবা দিতে তার পাশে যেতে না পারার মধ্য দিয়ে। এ যেন এক বড় অসহায়ত্ব।
অনেকে মনে করে পৃথিবীর এই বিপর্যয় প্রকৃতির অভিশাপও বটে। এই পৃথিবীটা করো একার নয়, মানুষ মনে করেছিল পৃথিবীটা তাদের একার। তাই নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করেছিল বন্য প্রাণীদের,ধ্বংস করতে শুরু করেছিল প্রকৃতিকে। আর করোনায় মানুষের গৃহবন্দির সুযোগ নিয়ে প্রকৃতিও দেখিয়ে দিল তাদের দখলদারিত্ব কিংবা বিচরণ। এই তো কয়েক দিন আগেও আমরা দেখলাম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিরল চিত্র। ডলফিন খেলা করছে আপন মনে। অনেক দেশে বন্যপ্রাণী নেমে এসেছে রাস্তায় ও লোকালয়ে ।
দূষণ কমে আসায় গাছ গাছালি, লতা-পাতা ফিরে আসছে পূর্ণ যৌবনে। আমরা বলতে পারি প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ আমরা শুরু করেছিলাম তার ফলাফল -হয়তোবা এটি। মানুষকে ভুলে গেলে চলবে না পৃথিবীটা গাছগাছালি, লতাপাতা,বন্যপ্রাণী,পোকা মাকড় থেকে শুরু করে সবার। মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে যে যুদ্ধে নেমেছিল তার প্রভাব সৃষ্টি কর্তা হয়তো বুঝিয়ে দিয়েছেন।ফিরে আসুক মানুষের মনুষ্যত্ববোধ। নতুন রুপে ফিরে আসুক পৃথিবী। শান্তি ও সমতার বার্তা নিয়ে পূর্ণ যৌবনা হয়ে ফিরে অাসুক।সকলের মঙ্গল কামনায়।
লেখক: শিক্ষার্থী পিলিপস ইউনির্ভাসিটি, জার্মানি
এসএস/এমএইচ/বাংলাবার্তা