না, বলব না স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের অতীত বর্তমান কাহিনি নিয়ে কিছু। অনেক বলেছি। অনেক লিখেছি। এবার শুধুই প্রশংসা করব। বলব, আহা বেশ বেশ, উনারা ভালো করেছেন, করছেন, আগামী দিনেও ভালো করবেন। উনাদের আরও পদোন্নতি প্রয়োজন। একটি নয়, প্রয়োজনে বাড়ানো হোক আরও মন্ত্রণালয়।
একদা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আ ফ ম রুহুল হক ছিলেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে মামলা করলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টারের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। একটি নয়, অনেক। আমরা নীরবে মেনে নিয়েছি সবকিছু। রিপোর্ট করেছিলাম মিঠু সিন্ডিকেটের লুটপাট নিয়ে। মালামাল সাপ্লাই না দিয়ে বিল তুলে নেওয়া নিয়ে। মন্ত্রী ভালোভাবে নেননি। কেন নেননি জানি না। শুনেছি মিঠু সিন্ডিকেটের সঙ্গে মন্ত্রীর ছেলের সম্পর্ক ছিল। তা নিয়ে আমরা লিখিনি কিছু। তবু মামলা খেলাম। সেই মামলা এখনো আছে। মন্ত্রী সাহেবও আছেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে। এরপর এলেন নাসিম ভাই। না, প্রবীণ এই রাজনীতিবিদকে নিয়েও বলব না কিছু।
ব্যক্তিগতভাবে আমি শ্রদ্ধা করি নাসিম ভাইকে। গ্রামে সরকারিভাবে নির্মিত হাসপাতালের ভবনগুলো পড়ে আছে। সেই হাসপাতাল তিনি চালু করতে পারেননি। ঘুরে এলেন। দেখলেন। অঙ্গীকার করলেন। পারলেন না। সমস্যা নেই। আশা ছিল বন্ধ করবেন মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেট। না, পারলেন না। স্বাস্থ্য খাতের বেহালদশা অব্যাহত থাকল। কেটে গেল আরও পাঁচ বছর। প্রিয় নাসিম ভাইকে নিয়েও বলব না। মন খারাপ করব না তিনি কেন পারলেন না তা নিয়ে। তিনি চলে গেলেন। এলেন জাহিদ মালেক সাহেব। তিনি ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। শুনেছি, সব সময় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নালিশ করতেন। তাই পেলেন পদোন্নতি। না, তাকে নিয়েও বলব না আর। বললেই সমস্যা। পদোন্নতি হয়। তাই এবার দাবি করব জাহিদ মালেক সাহেবকে আরও বড় দায়িত্ব দেওয়া হোক।
প্রশ্ন করব না, স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়গুলো ঠিকভাবে হয়েছে কিনা। জানতে চাইব না সাপ্লাই করা ইকুইপমেন্টগুলো ঠিক ছিল কিনা। প্রশ্ন করব না র্যাবের জব্দ করা নকল মাস্ক, পিপিই ও ভাইরাস পরীক্ষার কিট কোথায় দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছিল। জানতে চাইব না একটি কোম্পানি কীভাবে চিকিৎসা মাস্কের পরিবর্তে ফেস মাস্ক সাপ্লাই দেয়। আবার বিজ্ঞাপন দিয়ে দায় স্বীকার করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলে, ভুলে এটা হয়েছে। এই ভুলের দায় কে নেবে?
না, প্রশ্ন করব না। ঠিকাদারের সঙ্গে আড়ালের মানুষ সম্পর্কে জানতে চাইব না। সময়টা ভালো নয়। চারপাশে সব দেখে মন ভরে গেছে। বেদনার নীল আভা হৃদয় তছনছ করে দিয়েছে। হতাশা ভর করেছে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে।
এক তরুণ ফোন করল সেদিন। বলল, ভাইয়া! জেলার ত্রাণ বণ্টনের দায়িত্ব সচিবদের দিল কেন? আমি পাল্টা জানতে চাই, সমস্যা কী দায়িত্ব দিলে। এখানে তোমরা ত্রাণের তালিকা তৈরি নিয়ে আকবর আলি খানের সেই গল্প নিয়ে এসো না।
আকবর আলি খান পাকিস্তান আমলে ত্রাণের জন্য ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা নিয়ে ওপর থেকে নির্দেশ বাস্তবায়নে পাছায় লাথি মারার ঘটনা তুলে ধরেছিলেন তার এক বইতে। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের নির্দেশে চেয়ারম্যানের লাথি খেয়ে তালিকা তৈরির কাজ বাস্তবায়ন করল চৌকিদার। সে তালিকায় বণ্টন হলো ত্রাণ। সেই সুযোগ এখন আর নেই। ছেলেটি বলল, না ভাই! আমি আকবর আলি খানের লেখা পড়িনি। তবে মনে হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী রাজনৈতিক মন্ত্রীরা সমন্বয়ের দায়িত্ব পাওয়ার কথা। অতীতে তাই দেখেছি। সরকারে মন্ত্রীর অভাব নেই। উপদেষ্টার অভাব নেই। আছেন দাপুটে এমপিরাও। তারাই তো রাজনীতি করেন। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। বললাম, তারা এখন কোথায়? কতজন মন্ত্রী-এমপি মানুষের পাশে আছেন? কাজ করছেন ত্রাণ বণ্টন এবং পরিস্থিতির মোকাবিলায়? গত এক মাস তাদের পারফরম্যান্স কী?
হাসপাতালগুলোয় কেউ গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন চিকিৎসার? চিকিৎসকদের পাশে কেউ দাঁড়িয়েছেন? মানুষের কথা কেউ শুনেছেন? ছেলেটি এবার চুপ হয়ে গেল। বলল, আসলেই ঠিক বলেছেন। সব মিলিয়ে সারা দেশে হিসাব করলে ২৫-৩০ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপি মাঠে নেই। আর্তমানবতার সঙ্গে কারও কোনো সম্পর্ক নেই। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই করেছেন। তিনি বাস্তবতা বোঝেন। দেশের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে চান। এই কঠিন সময়ে রাতদিন সবকিছুর মনিটরিং করছেন। বাকি কারও কোনো খবর নেই। তৎপরতা নেই। অনেকের আছে শুধু লম্বা লম্বা কথা। ফেসবুকে লেখালেখি।
কথা বাড়ালাম না। জেলা সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। হতাশ নই, বিস্মিত নই। রাজনৈতিক মন্ত্রী-এমপিরা আসলেই পারছেন না। তারা ঘরে ঢুকে গেছেন। করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। সুযোগ দিয়েছে বাস্তবতা উপলব্ধির। রাজনীতিকরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আমলারা আসেন। দেশ চালাতে হবে। সমন্বয়টা হতে হবে সঠিকভাবে। এখন বৈশ্বিক মহামারীর সময়। এই সময়ে দায়িত্বহীনতার সুযোগ নেই।
দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে ঘরে থাকারও সময় নয়। সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। সাবধানে চলতে হবে। নিজেকে রক্ষা করতে হবে। আর অন্যকে বাঁচাতে পালন করতে হবে দায়িত্ব। অনেক মন্ত্রী-এমপি লকডাউনে। বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। খোঁজও নিচ্ছেন না নির্বাচনী এলাকার। ফোনও ধরেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব খবর আছে। আর খবর আছে বলেই আমলাদের দায়িত্ব দিয়েছেন।
মনিটরিং করছে প্রধানমন্ত্রীর অফিস। কাজটা হবে এখন অন্যভাবে। আর মানুষ বাঁচাতে এখন কাজ দরকার। যে প্রক্রিয়াই হোক না কেন। এখানে রাজনৈতিক নেতারা না পারলে অন্য কাউকে করতে তো হবেই। না হলে আগামী দিনের বিপর্যয় মোকাবিলা করা যাবে না।
ক্ষমতাবান মাননীয়রা পারছেন না কেউ অহমিকার কারণে। কেউ পারছেন না অতি দম্ভে। আর বাকিরা করোনাভাইরাসের ভয়ে পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার ভয়ে। ভয়াবহতা থেকেও শিখছে না কেউ। বিশ্বের প্রায় ২ লাখ মানুষ ‘নাই’ হয়ে গেছে। চলে গেছে চিরতরে। আর ফিরবে না। সামনে আসছে আরও কঠিন সময়। সেই অবস্থান মোকাবিলা নিয়ে কারও ভাবনা নেই। চিন্তা নেই।
আগামী দিনে একটি সত্যিকারের ভোট মোকাবিলা করতে হবে না- এই গ্যারান্টি কে কাকে দেবে? অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। বাস্তবতায় থাকতে হবে। সব দায়িত্ব একজনের নয়। দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ২০০১ সাল-পরবর্তী ভয়াবহতা। অবশ্য এখনকার মাননীয়দের বেশির ভাগকেই মুখোমুখি হতে হয়নি হামলা-মামলার। করতে হয়নি আন্দোলনের।
আবার কারও অভিজ্ঞতা আছে ২০০১ সালে মনোনয়নের জন্য হাওয়া ভবনে যাওয়ার। অনেকে ছিলেন বাবার হোটেলে। পুরনো ইতিহাসে গেলাম না। ২০১৪ সালের অবস্থাও অনেকে ভুলে গেছেন। নিজের এলাকায় যেতে পারেননি অনেকে। আবার র্যাবের সেই সময়ের কর্নেল জিয়া অনেককে হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনেছেন। পুলিশ পাহারায় অনেকে থেকেছেন নিজের বাড়িতে।
আগামীতে সত্যিকারের একটি ভোট হলে টের পাবেন অনেক কিছু। এই খারাপ সময়েও দলের ভিতরে বাইরে অকারণে সংকট তৈরি করছেন। ভুলে গেছেন অতীত। অতীতের সঙ্গে টিকে থাকে বর্তমান। মনে রাখুন, সবকিছু সব সময় এক রকম যায় না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। বিশ্বের অস্তিত্বই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। এই বিশ্ব কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারছে না।
বিজ্ঞানীরা আগামাথা খুঁজে পাচ্ছেন না। হাল ছেড়ে দিয়েছেন বড় বড় রাষ্ট্রনায়ক। তার পরও দম্ভ দেখাতে হবে? ভাব নিয়ে চলতে হবে? ভাব শেষ হয়ে যায় মুহূর্তেই। ক্ষমতা তো তাসের ঘর। উড়ে যায় মুহূর্তের নোটিসে। বাস্তবতা বুঝতে ঘর থেকে বের হোন। হাসপাতালগুলো দেখে আসুন। টের পাবেন মানবতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। মনে রাখুন আপনাদের ব্যর্থতার কারণেই আমলারা ত্রাণের দায়িত্বে। লকডাউন ভেঙে মানুষের পাশে দাঁড়ান। খারাপ সময়ে পাশে দাঁড়ালে মানুষ মনে রাখে।
জানি এত কথায়ও হুঁশ হবে না কারও। বরং করোনার ক্রান্তিকাল শেষ হলে আগামী দিনগুলোকে আরও কঠিন করে তুলবেন অনেকে। আরও বিতর্কিত আচরণের প্রকাশ ঘটাবেন। ঝামেলা বাড়াবেন স্থানীয় রাজনীতিতে। খুনোখুনিতেও জড়াবেন কেউ কেউ। এর মাঝেও ফরিদপুরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারা গেছেন একজন। আরও অনেক এলাকায় চলছে দলীয় সংঘাত। নিজেদের হানাহানি-কোন্দল। ঝামেলা না করে কিছু মানুষ থাকতে পারে না। শান্তি ভালো লাগে না রাজনীতি করতে এসে।
তাই বলে এই করোনাকালে করতে হবে? চারদিকে কি কারও চোখ যায় না? এক কঠিন সময় অতিক্রম করছি আমরা। ত্রাণের গাড়ি লুট হচ্ছে। গার্মেন্টকর্মীরা বেরিয়ে আসছেন। বাড়ছে সামাজিক অপরাধ। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণও হচ্ছে। সমাজের স্বাভাবিক স্থিতি কমছে। মানুষ হয়ে উঠছে অস্থির। এ অস্থিরতার পরিণতি ভালো হতে পারে না। তার পরও থামবেন না আপনারা নষ্ট নোংরামি থেকে? নেতা-কর্মীরা জানে কোন নেতারা লকডাউনে। আর লকডাউন ছাড়া কে আছেন। সচিবদের দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে একটা বার্তা দিলেন। এ বার্তা সতর্ক হওয়ার। আগামী দিনের রাজনীতিতে টিকে থাকার। নিজের অবস্থান স্বচ্ছভাবে সামনে আনার। কেউ পারবেন কিনা জানি না। অর্থ ও ক্ষমতার গরম ভয়াবহ। সবাই হজম করতে পারে না। এর মাঝে অনেকের চেহারা দেখছি। ভাবের শেষ নেই। ক্ষমতা-অর্থ দুটোই আছে।
তাই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা তাদের অহংকারে পরিবর্তন আনতে পারেনি। হায়রে রাজনীতি! মানুষ না বাঁচলে কীসের রাজনীতি? গাজীপুরের এসপি শামসুন নাহারের কাছ থেকে শিখুন। মানুষ আজ তার প্রশংসা করছে। আলোচনা করছে ময়মনসিংহের সেই নার্সকে নিয়ে। সম্মান জানাচ্ছে সেই ভিখারিকে যিনি নিজের জমানো ১০ হাজার টাকা দান করেছেন ত্রাণের জন্য। এই মানুষটার কাছে আমাদের শেখার আছে। তিল তিল করে ১০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন ঘর করার জন্য। সেই টাকাই তুলে দিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে। সেই খবরের পরও দুনিয়ার বাদশাহরা এখনো বসে আছে। তারা তামাশা করছে। ব্যাংক লুটেরাদের একজনকেও দেখিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ দিতে।
আর্তমানবতার পাশে কোথাও দাঁড়াতে। মানুষের পাশে থাকতে হলে মন লাগে। সেই ভিখারির মনটা আছে। আর লুটেরাদের মন নেই বলেই দেশের অর্থ লুট করেছে। বিদেশে পাচার করেছে। সেই অর্থ এখন ফেরত আনা হোক। দেওয়া হোক করোনা মোকাবিলার তহবিলে।
কবিগুরু বলেছেন, ‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম/আপনার রূপ,/চিনিলাম আপনারে/আঘাতে আঘাতে/বেদনায় বেদনায়;/সত্য যে কঠিন,/কঠিনেরে ভালবাসিলাম,/সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে হবে। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে সবকিছু। এখন চাটুকারিতার সময় নয়। নষ্টামি আর ভণ্ডাামির সময় নয়। হানাহানি-বিভেদের সময় নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও মহামারী বারবার আঘাত হেনেছিল। কবিপুত্র সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমী মারা গেলেন কলেরায়। ঠাকুরবাড়িতে মহামারীর প্রথম আঘাত প্লেগের সময়। অবনীন্দ্রনাথের শিশুকন্যা মারা যায় প্লেগে। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে মহামারীর কবল থকে নিস্তার পেতে নিজেও পঞ্চতিক্ত পাচন খেতেন। বলতেন, লিখতেন মানবতার কথা। মানুষ না বাঁচলে কী হবে এত কিছু করে? কোথায় যাবে ক্ষমতার সব দম্ভ?
স্বামী বিবেকানন্দ কাজ করেছেন প্লেগে আক্রান্ত মানুষের জন্য। ১৮৯৮ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। সিস্টার নিবেদিতা নিজের জীবন বিপন্ন করে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আক্রান্ত মানুষের পাশে। গেয়েছেন মানবতার গান। মানুষই দাঁড়াবে মানুষের পাশে। কারণ আসছে কঠিন সময়। মহামারীর দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে দুর্ভিক্ষ। ইতিহাস তাই বলে। মহামারীর মৃত্যুর মিছিলের কারণের কথা নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, অনাহার অপুষ্টির কথা। ভয়াবহ প্লেগে শরৎচন্দ্র হারিয়েছিলেন স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে। একবুক বেদনা ছিল শরৎচন্দ্রের। সেই বেদনা নিয়েই কাটিয়েছেন বাকি জীবন। শরৎচন্দ্র নিজেই মহামারী নিয়ে সতর্ক করেছেন তাঁর উপন্যাসে।
শ্রীকান্ত উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে শরৎ লিখেছেন, ‘পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যকর চিহ্ন দেখা দিল। চারদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা Quarantine:: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশ দিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।’
বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে আমরা অকালমৃত্যুর ছায়া দেখতে পাই। স্প্যানিশ ফ্লু নামে খ্যাত এই মহামারীর কিছু চিত্র আমরা পাই কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠীর লেখনীতে। তিনি ‘নিরালা’ ছদ্মনামেই বেশি লিখতেন। তারাশঙ্করের ‘ধাত্রী দেবতা’ উপন্যাসে শিবনাথ ব্যস্ত ছিলেন কলেরা মহামারীতে মানবসেবায়। সেই মহামারী নতুনভাবে আজ বিশ্বে আঘাত হেনেছে। আমেরিকার মতো দেশে মারা গেছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। ইউরোপ লণ্ডভণ্ড। এশিয়া চ্যালেঞ্জে। আমরা পার করছি ভয়াবহ কিছু সময়। আমাদের আগামী নিয়ে থাকতে হবে সর্বোচ্চ সতর্কতায়। ভুলে যেতে হবে দুনিয়ার অনেক কিছু। দাঁড়াতে হবে মানবতার পাশে। প্রার্থনা করতে হবে সবকিছুর স্বাভাবিকতা ফিরে আসার। জানি না কোথায় গিয়ে ঠেকব? কত মৃত্যুর বিনিময়ে পৃথিবী ফিরে পাবে স্বাভাবিকতা। তবু প্রার্থনা করতে হবে মহামারী শেষে এক নতুন পৃথিবী দেখার। অন্ধকার কেটে চারপাশে আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ার।
দূর হোক আকাশের কালো মেঘ। ফিরে আসুক মানুষের স্বাভাবিকতা। লোহিত সাগরে বসে কবির সেই লেখা দিয়েই শেষ করছি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে/মোরে আরো আরো দাও প্রাণ।/তব ভুবনে তব ভবনে/মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান॥/আরো আলো আরো আলো/এই নয়নে প্রভু ঢালো।’ জগতের এ প্রার্থনাই এখন আমাদের সামনে এক নতুন সূর্যের প্রতীক্ষার। কেউ জানি না সেই প্রতীক্ষার অবসান কবে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২০
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।