তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠা বানরের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা কার্যকরী!

বিদেশে হাতে কলমে শিক্ষার একটি দৃশ্য

নিউজ ডেস্ক:

স্থানীয় একটি জার্মান স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন আমার ছেলে একদিন স্কুল থকে এসে বলল- যে ওদেরকে ‘আলুর ক্ষেত’ দেখাতে নিয়ে যাবে। ভালো কথা। স্কুল থেকে তো ওদেরকে লাইব্রেরী, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, ফায়ার ষ্টেশন ইত্যাদি কতো জায়গাতেই নিয়ে যায়, এ আর এমন কি বলে পাত্তা দিলাম না! পরেরদিন বাসায় ফিরে বলল, “ওরা ক্লাসের সবাই মিলে আলুর ক্ষেতে গিয়ে অনেক মজা করে আলু তুলেছে, কৃষকের সাথে আলুর চাষ-পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছে।

ওদের ক্লাস-টিচার সুন্দর করে বুঝিয়েছে আলুর ইতিহাস, প্রকারভেদ, উপকারিতা, পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। তারপর সেই আলুগুলো সঙ্গে করে এনে ধুয়ে-কেটে স্কুলের কিচেনেই আলুর চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বেইক করে সবাইকে খাইয়েছে। সবশেষে একটা ছোট্ট ‘টেস্ট’ নিয়েছে আলু বিষয়ে কে কতোটুকু শিখলো তা জানতে।

ছেলের কাছ থেকেই তখন জানলাম যে আলু ইউরোপে প্রথম এসেছিল ল্যাটিন আমেরিকা থেকে। আরও বুঝলাম, ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদেরকে তারা কিভাবে খেলার ছলে মাটি ও মানুষের সাথে পরিচিত করে, প্রকৃতিকে চেনায়, কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করে, নিজ-হাতে রান্না করে আত্মনির্ভরশীল হতে শেখায়।

আলু যে মাটির উপরে না হয়ে মাটির নীচে হয়, এটাই মনে হয় জেনেছিলাম ক্লাস এইট বা নাইনে উঠে। এরপরের দৌড় ঐ বায়োলজি খাতায় ট্রেসিং-পেপারে কপি-পেস্ট করে আলু আঁকানো আর আলুর বৈজ্ঞানিক নাম মুখস্ত লিখে ইন্টারে লেটার পেয়ে কলার উঁচিয়ে ঘোরাঘুরি পর্যন্ত।

আদতে আমরা শিখিনি কিছুই। শুধু পিকনিকে না গিয়ে স্কুলের শিশুদেরকে নিয়ে মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, চিড়িয়াখানা, কৃষিকাজ বা শিল্প-কারখানা দেখানো কি বাংলাদেশের স্কুল-কর্তৃপক্ষের জন্য খুবই কঠিন কাজ! এজন্য ভাড়া-বাবদ কিছু অতিরিক্ত টাকা দিতে কি কোনো অভিভাবক গড়িমসি করবে? মনে তো হয় না!

একটা জাতির ভবিষ্যৎকে পঙ্গু করতে চাইলে শুধু সেই জাতির প্রাথমিক শিক্ষার মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দেওয়াটাই যথেষ্ট। আমাদের অভিভাবকরা ব্যস্ত পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষায় নকল সাপ্লাই দিতে। স্কুল ব্যস্ত শিশু-বহিষ্কারে। ফলাফল “আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ” না পাওয়া নিয়ে মনকষাকষি আর আত্মহত্যার মিছিল।

ঘানার রাজধানীর নাম মুখস্ত করে সরকারি কর্মকর্তা বনে যাওয়া সেই দেশের ৪০ জন আমলা আলুর চাষ-পদ্ধতি দেখতে ইউরোপে এসে জনগণের ট্যাক্সের টাকা উড়াবে- এটাই তো স্বাভাবিক! আমলারা এরপর হয়তো ইউরোপে এসে গরুর ঘাস কাটা বা দুধ দোহন শিখে দেশে গিয়ে গরুর রচনা লিখে প্রোমোশন বাগাবে আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে লিখবে, “আলহামদুলিল্লাহ্ ফর এভরিথিং”।

৪০ আমলার জনপ্রতি ৭ লাখ টাকা প্রমোদ-ভ্রমণের ঐ ৩ কোটি টাকা অন্তত ৩০০ টা স্কুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা যেত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্যিকারের কৃষকের কাছে পাঠিয়ে আলু বা ফসলের চাষ শেখান। হয়তো একদিন তাদের মধ্যে থেকেই অন্তত ৩ জন ‘শাইখ সিরাজ’ ঠিকই বের হয়ে আসবে।

তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠা সেই বানরটা আজ পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মাথার উপরে উঠে ঘাড় মটকানো শুরু করেছে। এই আলুচাষ-পুকুরকাটা দেখতে ইউরোপে আসা প্রকল্পগুলো তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ।