সোহরাব সাহল:
করোনা ভাইরাসারের কারণে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন চট্টগ্রামের মানুষ। সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে মানুষগুলো হাতড়াচ্ছে হাসপাতালের দোয়ারে দোয়ারে। চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে হরহামেষাই। অবহেলিত চিকিৎসা সেবা যেন মানুষের মৃত্যুর কারণ। সবাই এখন করোনা রোগীর দোহায় দিয়ে হাসপাতালের গেইট বন্ধ করে দিচ্ছে। সাধারণ রোগীদের নেই কোন চিকিৎসা সেবা।
তাদেরই একজন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ৬ বছরের শিশু ঈশান। বৈদ্যুতিক র্শট সার্কিটে আহত হয়ে একটি হাত, একটি পা ও লিঙ্গ হারানোর পর কয়েকমাস ঢাকায় চিকিৎসা নেয়। ডাক্তারের পরামর্শে পরবর্তী চিকিৎসা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলা হলেও দু’মাসে তিনবার এসেও করোনার অজুহাতে চিকিৎসা পাননি। সন্তানকে নিয়ে অসহায় ইব্রাহিম রোববার ভর্তি করাতে না পেরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে ফিরে যান।
শুধু ইব্রাহিম-ই নয়, এভাবে প্রায় প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছে শত শত রোগী। করোনার দোহায় দিয়ে অন্য রোগীদের ভর্তি নিচ্ছেনা হাসপাতালগুলো। বহু মানুষ এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ঘুরেই এ্যাম্বুলেন্স কিংবা সিএনজিতেই মারা যাচ্ছেন। দেখার যেন কেউ নেই। এসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। পরে আবারও একই চিত্র চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোর।
চিকিৎসা সেবার এমন পরিণতির বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বাংলাবার্তাকে বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের চিকিৎসা সেবায় সাধারণ রোগীরা যে কতটুকু অবহেলিত এ সম্পর্কে আমার বেশ কিছু লিখা আছে। আমি চেয়েছি সেগুলোতে এ অবহেলার কথা তুলে ধরতে। চট্টগ্রামে করোনা না হলে আমরা বুঝতেই পারতাম না এখানের চিকিৎসা সেবা এত বেশি দুর্বল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনজর ছাড়া এ দূর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। এ বিষয়গুলো ওনাকে জানাতে হবে।
এছাড়াও ১১ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের চৌধুরীর পিতাও চিকিৎসা সেবায় অবহেলার কারণে মৃত্যু বরণ করেছেন বলে দাবি পরিবারের।
জানা যায়, ১১ জুন (বুধবার) দিবাগত রাত সোয়া ২টার দিকে মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত প্রচুর ব্যথা অনুভব করেন জসিম উদ্দিন চৌধুরী। তাঁর ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জোবায়ের চৌধুরী একটি বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। তারা রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে বলেন। রোগীকে নিয়ে যেতেই হাসপাতাল কতৃপক্ষ সীট খালি নেই বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। কোন উপায় না পেয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। সেখানেও শিকার হন হেনস্তার। পরে চিকিৎসক জসিম উদ্দিন মৃত ঘোষণা করেন।
জসিম উদ্দিনের ছেলে জোবায়ের চৌধুরী বলেন, বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ন্যাশনাল হাসপাতালে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি জানাই। সেখান থেকে বলা হয় ‘জরুরি বিভাগ চালু আছে রোগীকে নিয়ে আসুন।’ এরপর বাবাকে সিএনজিতে উঠানোর পর আবারও হাসপাতালে ফোন করে নিশ্চিত হই। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কোনো চিকিৎসক এগিয়ে আসেননি। হাসপাতালের এক ওয়ার্ডবয় এসে অক্সিজেনের মাত্রা মেপে দেখে জানান বাবার অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন। এরপর ওই ওয়ার্ডবয় চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর জানান, তাদের হাসপাতালে শয্যা খালি না থাকায় ভর্তি করা সম্ভব নয়।
জোবায়ের চৌধুরী বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া গেলে হয়তো বাবাকে বাঁচানো যেত। কিন্তু ন্যাশনাল হাসপাতাল সেই সেবা দেয়নি। পরে কোনো উপায় না দেখে বাবাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানেও কোনো চিকিৎসকের দেখা পাইনি। ওয়ার্ডবয় ও আয়া এসে ইসিজি করার পর জানান, বাবা আগেই মারা গেছেন।
জসিম উদ্দিন ছাড়াও এভাবে প্রতিদিন হাসপাতালের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতেই মারা যাচ্ছেন অনেক রোগী। প্রতিকারের কোন উপায় খোজছেন না হাসপাতাল কতৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল হাসপাতালের পরিচালক আনোয়ার শহীদ বলেন, আমাদের শয্যা সংকট আছে এটি ঠিক। তবে একজন রোগীকে তো আগে ভর্তি করাতে হবে, অক্সিজেন সেবা দিতে হবে। এটি উচিত হয়নি। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি।’
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসাসেবা তদারকির কমিটির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়গুলো আমরা নজরদারি করছি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে হাসপাতালগুলোকে আমরা সতর্ক করব। এরপরেও যদি তারা রোগী ভর্তি না নেয় তাহলে আইনগত পথে হাঁটব।
এসএস/এমএইচ/বাংলাবার্তা