কথিত বন্দুক যুদ্ধে বখাটে জয়নালের জায়গায় প্রাণ গেল শিক্ষার্থী জয়নালের!

225
শিক্ষার্থী জয়নাল

আহমেদ সাব্বিরঃ

নাম জয়নাল। পড়তেন চট্টগ্রামের বায়জিদে অবস্থিত ভোকেশনাল অ্যান্ড টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে। সে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। স্বভাব ছিল নম্র, ভদ্র ও মার্জিত। এলাকার সবাই ভালো ছেলে হিসেবেই চিনতো তাকে। পিতা-মাতার একমাত্র আলোর প্রদীপ জয়নাল। সামান্য নামের ভুলের কারণে অকালে নিভে যেতে হয়েছে এ আলোকবর্তিকাকে। ধ্বংস হয়েছে পরিবারের হাজারো স্বপ্ন।

পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যে জয়নাল প্রাণ হারিয়েছে, সে আসলে ওই মামলার আসামি নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাম ভুল করায় নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। যদিও শিক্ষার্থী ও আসামির নাম এক হলেও তাদের বাবার নাম ভিন্ন ছিল। শিক্ষার্থী জয়নালের বাবার নাম নুরুল ইসলাম আর
বখাতে জয়নালের বাবার নাম আব্দুল জলিল।

তিন বোনের এক ভাই ছিল শিক্ষার্থী জয়নাল। সুতা শ্রমিকের কাজ করেন পিতা নুরুল ইসলাম। তার সঙ্গে স্ত্রী জোহরা বেগমও কাজ করেন। তাদের তিন মেয়ে ও একমাত্র ছেলে ছিল জয়নাল। পরিবারের আশা ছিল, জয়নাল পড়া শেষ করে গার্মেন্টে বড় চাকরি করবে। তবে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। জয়নাল পরিবারের সঙ্গে থাকত নগরীর আমিন জুট মিল কলোনি এলাকায়। জয়নালের বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদীতে।

তার মা জোহরা বেগম অভিযোগ করেন, একমাত্র ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে পুলিশ। এখন আমার ছেলেকে খারাপ বানানোর জন্য অনেকেই অনেক কিছু বলছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে সত্য বের হয়ে আসবে। সরকারের কাছে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করছি।

একই ক্লাসে পড়া বোন প্রিয়া বলে, আমি আর আমার ভাই জয়নাল দশম শ্রেণিতে পড়তাম। একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। একসঙ্গেই বাসায় ফিরে আসতাম। ভাই কোনো ঝামেলায় ছিল না। মাঝেমধ্যে মিছিল-সমাবেশে যেত। এটাই তার জন্য কাল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
সে যদি অপরাধী হতো, তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো যেত; তারপর বিচার হতো।

জয়নালের সহপাঠী মো. সিদ্দিক বলেন, তারা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। জয়নাল কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়াত না। তবুও তাকে বড় অপরাধীর মতো মেরে ফেলার কারণ বুঝতে পারছি না।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর বায়েজিদ থানার রৌফাবাদ পাহাড়িকা আবাসিক এলাকার শাহ আলমের বাসায় ঢুকে মারধর, হত্যাচেষ্টা ও চুরির ঘটনায় সাতজনের নামে মামলা হয়। বখাটে মো. জয়নালকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। তবে ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থী মো. জয়নালকে আটক করে বায়েজিদ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের সামনের মাঠে কথিত অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে যায় পুলিশ।

পরে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ পর একটি দেশীয় এলজি, কিরিচ ও চারটি কার্তুজের খোসা উদ্ধার করার তথ্য জানানো হয়।

একই সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এসআই গোলাম মোহাম্মদ নাসিম হোসেন ও কনস্টেবল মাসুদ রানা আহত হন বলে দাবি করে পুলিশ।

তারপর তদন্ত শেষে পুলিশ গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর আসামি বখাটে জয়নাল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে উল্লেখ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। একই বছরের ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট দাখিল করে কোর্ট পুলিশ।

ওই দিনই শুনানির পর চার্জশিট আমলে নিয়ে ‘মারা যাওয়া’ বখাটে আসামি জয়নালকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। এর পর হঠাৎ চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি এ মামলার শুনানির দিন আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দাখিল করে বখাটে জয়নাল। মামলার বিচার কার্যক্রম এখন সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে।

বখাটে আসামি জয়নালের জায়গায় পুলিশ শিক্ষার্থী জয়নালকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ফেলেছে। চার্জশিটেও উঠে এসেছে সে তথ্য। অনুসন্ধানেও মিলেছে তার সত্যতা। সবাই শিক্ষার্থী জয়নালকে শান্ত ও ভালো ছেলে হিসেবে চিনতেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সবাই বলেছেন, জয়নালের মধ্যে কোনোদিন খারাপ কিছু নজরে আসেনি। এ রকম একজন শিক্ষার্থী নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের মাঠেই গভীর রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

এ ব্যাপারে আসল আসামি জয়নাল বলেন, আমাকে মারতে গিয়ে হয়তো জয়নাল নামে আমিন জুট মিল এলাকার একটি ছেলেকে পুলিশ মেরে ফেলেছে। হায়াত আছে বলে এখনও বেঁচে আছি। আমি মরে গেছি ভেবে পুলিশ চার্জশিট থেকেও নাম বাদ দিয়ে দেয়। যেহেতু বেঁচে আছি,তাই পুলিশ মামলা থেকে নাম বাদ দিলেও আদালতে আসামি হিসেবে হাজিরা দিয়ে জীবনকে রক্ষা করতে চাইছি। আরেক জয়নালকে মেরে ফেলার বিষয়টি জানতে পেরে ভয়ে তাড়াতাড়ি ওই মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, মামলার নথিতে আসল আসামি মো. জয়নালের নিয়মিত হাজিরা দেওয়ার আবেদনগুলো সংযুক্ত রয়েছে। বর্তমানে মামলাটি চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে বিচারাধীন।

এ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী চট্টগ্রাম মহানগরের অতিরিক্ত পিপি আবিদ হোসেন বলেন, মামলার ২ নম্বর আসামি আবদুল জলিলের ছেলে মো. জয়নালের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ার তথ্য চার্জশিটে তুলে ধরা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কাগজপত্রও সিডিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

তবে এখন দেখছি, ‘মৃত’ আসামি জয়নাল আদালতে হাজিরা দিচ্ছে। তাহলে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এ মামলার আসামি জয়নাল মারা যায়নি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্যজন মারা গেছে।

অ্যাডভোকেট আবিদ আরও বলেন, আগামী ৬ অক্টোবর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন আদালতে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাটি আসলে কী ছিল, তা বের করতে জুডিশিয়াল তদন্তের জন্য আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দিপংকর চন্দ্র রায় বলেন, যখন এ মামলার তদন্তভার নিই, তখন বায়েজিদ থানায় নতুন যোগদান করেছিলাম। ভুল করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়া জয়নালকে এ মামলার আসামি জয়নাল ভেবে চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছি। তাহলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেল কোন জয়নাল? জবাবে এসআই দাবি করেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়া জয়নাল খুবই বেপরোয়া প্রকৃতির তরুণ ছিল। তার বিরুদ্ধে দু-তিনটি মামলা রয়েছে বলে শুনেছি। সে শিক্ষার্থী কিনা জানা নেই।

এফএম/বাংলাবার্তা