ডক্টর তুহিন মালিক
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাদের পার্লামেন্টে বহিঃবিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে একটি সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।
অমিত শাহ “বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের কাছে তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পালন করা অসম্ভব” বলে লোকসভায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে একটি সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে সকলের জন্য সমান ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের সাংবিধানিক রক্ষাকবচের বিরুদ্ধে এহেন নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে অমিত শাহ বিশ্ববাসীর চোখে বাংলাদেশকে একটি অপরাধী উগ্রবাদী রাষ্ট্র বানিয়ে দিলেন! যা প্রতিবেশী একটি বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে চরমতম মূর্খতাপূর্ন কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত একটি অকৃতজ্ঞ আচরনের বহি:প্রকাশ।
যখন সারাবিশ্বের মানুষের দৃষ্টি ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসির উদ্ভুত চলমান সংঘাতের উপর নিবদ্ধ। যখন জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুরু করে প্রভাবশালী দেশগুলো পর্যন্ত ভারতের উগ্রতার নিন্দা জানাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে ভারতের পার্লামেন্টে দাড়িয়ে বাংলাদেশকে একটি সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করার কূটনৈতিক খেসারত বহুকাল ধরে বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে বহুকাল এই বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার সংস্থা এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রস্তুতকৃত মানবাধিকার রিপোর্টগুলোতে বাংলাদেশের এই অপরাধী চরিত্রটিকে নির্মমভাবে তুলে ধরা হবে। আর এটা হয়ত একসময় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহ এক দলিল হয়ে উঠতে পারে।
এটা শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হরণই করবে না। বরং এটা বাংলাদেশ ও তার নাগরিকদের নিরাপত্তার উদ্বেগের কারনও হয়ে উঠতে পারে।
ফ্রি ট্রানজিট, ফ্রি নৌবন্দর, ফ্রি সমুদ্রবন্দর, ফ্রি পানি, ফ্রি গ্যাস, ফ্রি তালপট্টি, ফ্রি চাকুরি, ফ্রি রেমিটেন্স, ফ্রি বানিজ্য, ফ্রি নিরাপত্তা এবং ফ্রি মাতাব্বরির বিনিময়ে ভারতের এই অকৃতজ্ঞ আচরন বন্ধুসূলভ তো নয়ই, বরং এটা যেন একটি চরম শত্রুরাষ্ট্রের ভয়ানক আচরন! আর সত্যিই যদি বাংলাদেশ সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তাহলে কেন এতবছরেও একবারের জন্যেও দ্বিপক্ষীয় বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈঠকে মোদি কিংবা অমিত শাহ সেই নির্যাতনের কোনরকমের প্রতিবাদটুকু জানাননি?
আসলে নিজ দেশে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর ক্রমাগত অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়নকারী মোদি-অমিত শাহ’র মুখে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের এহেন মিথ্যা কল্পকাহিনী মোটেও শোভা পায় না।
যেখানে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তা আজীবন মনে রাখবে’। সেখানে গত ১০ বছরে বাংলাদেশের বুক চিড়ে ভারতকে এক্সক্লুসিভ করিডোর দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি পাইপলাইন, রেল ও সড়ক অবকাঠামো যোগাযোগ, নাব্য নদীপথ ও বন্দর, সমুদ্রবন্দরসহ সব দিয়েও সেই বাংলাদেশই আজ অকৃতজ্ঞ ভারতের চোখে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের তকমা পেয়ে গেলো!
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার যতই বলুক, ‘এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না’। কিন্তু ভারতের পার্লামেন্টে অমিত শাহর বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের লেবেল এঁটে দেয়ার কি মারাত্মক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাবে, তা হয়ত নিকট ভবিষ্যতেই হাড়ে হাড়ে টের পাবে আমাদের বন্ধুপ্রেমী রিক্তহস্ত অভাগা এই জাতি!
আসলে, প্রিয়া সাহার ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ এবং বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ‘ডিসএপিয়ার’ হয়ে গেছে বলে দাবীটা ভারতের রাষ্ট্রীয় মহাপরিকল্পনার যে একটা সূদুরপ্রসারী অংশ ছিল, তা অমিত শাহর বক্তব্যে এতদিনে প্রমানিত হলো। উগ্র হিন্দুবাদী মোদি-অমিতরা তাদের দেশে নাগরিক পুঞ্জী এবং নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে তাদের কোটি কোটি মানুষকে নাগরিকত্বহীন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে সুকৌশলে বাংলাদেশকে তাদের ঘোষিত মহাভারতের অংশ করার মহাপরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। তাই আমাদের নিজেদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আত্মমযার্দা রক্ষার প্রয়োজনেই মোদি-অমিতের ‘বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করার’ এহেন গর্হিত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে শক্তহাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে হবে।
অনতিবিলম্বে অমিত শাহকে বাংলাদেশের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে মোদি-অমিতের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাশ করে বাংলাদেশের উপর এই মিথ্যা কলংকতীলক মুছে ফেলতে হবে। বিশ্ববাসী জানুক, বাংলাদেশ কোন সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশ কোন জঙ্গি রাষ্ট্রও নয়। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহঅবস্থানের এক চমৎকার নজিরবিহীন উদারচেতা রাষ্ট্র।
ডক্টর তুহিন মালিক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ