ইন্ডিয়ার ভেলোরে খ্রিষ্টান মিশনারি হাসপাতাল পুরো সাব কন্টিনেন্টেই বিখ্যাত। এই রকম বহু ক্যাথলিক খ্রিষ্টান মিশনারি হাসপাতাল ও এনজিও এই উপমহাদেশের আনাচে কানাচে কাজ করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় লোকদের একটা বড় অংশ বাপ দাদার ধর্ম ছেড়ে এখন খ্রিষ্টান হয়ে গেছে।
ছোট বেলায় নিজের ও আশে পাশের গ্রামের মুচি সম্প্রদায়ের যে লোকজনদের দেখেছি সীমাহীন দারিদ্রতায় মানবেতর জীবন যাপন করছে, মরা পচা জীবজন্তুর চামড়া ছিলে লবন দিচ্ছে, তারা এখন সবাই বিত্তশালী। আধুনিক পাকা ঘরে জীবন যাপনের সকল আধুনিক সুবিধা নিয়ে বসবাস করছে। ঘটনা খুবই ছোট্ট। এরা সবাই এখন খ্রিস্টান। হিন্দু ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে।
এই ছেড়ে দেওয়ার পিছনে খ্রিষ্টান মিশনারির লোকজনের বিরাট সফলতা আছে। এরা সমগ্র পৃথিবীব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। মানব সেবার মাধ্যমে মানুষের মন জয় করা, জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর সমাধান করা, দুঃস্থদের রাতারাতি বিত্তশালী করে দেয়ার মাধ্যমে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষীত করা। এই কাজটা এরা অত্যন্ত সফলতার সাথে পুরো উপমহাদেশ জুড়ে করে আসছে।
ইন্ডিয়ার কেরালায় প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন খ্রিষ্টান। বছরের পর বছরের মিশনারী কাজের ফল এগুলো। অত্যন্ত জননন্দিত মাদার তেরেসাও ১৮ বছর বয়সে যুগোস্লোভিয়া ছেড়ে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার ও মানবতার সেবার উদ্দেশ্যে সুদুর এই ভারতীয় উপমহাদেশে এসে সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন। জীবনে বিয়ে শাদীও করেননি। কলেজে পড়ার সময় জর্ডানের অধিবাসী একজন খ্রিষ্ট ভাইয়ের সাথে কথা হত মাঝে মাঝে। নবী ইব্রাহীম (আ:) পর্যন্ত উভয় ধর্মেই একই। এরপর ইহসাক আর ইসমাইলেকে নিয়ে আমাদের কথাবার্তায় গোলমাল লাগত মাঝে মাঝে। অত্যন্ত ভদ্র এই ভাইটিও জীবনে বিয়ে করেননি। পুরোটা সময় ধর্ম প্রচার ও মানব সেবায় ব্যয় করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। থাকতেন আশাশুনির বড়দলের চার্চে। উনি যদি ডাক্তার হতেন আর আমাদের মুচি পাড়ায় যদি একটা দোকান খুলে ফ্রি ওষুধ দিতেন তাহলে ঘটনা কিন্তু একটা ঘটে যেত।
জনাব হানিফ সংকেত সাহেব উনাকে নিয়ে ইত্যাদিতে ভিডিও বানাতেন আর দেখাতেন এই দেশের কালো চামড়ার ডাক্তাররা কত কসাই, গ্রামে থেকে মুচীদের সেবা দিতে চান না। আর গেরুয়া চামড়ার মিশনারীর এই ডাক্তার কত মহান! মুচিদের ফ্রি ওষুধ দেন! মা গো মা! একবার বিয়েও করেননি। জীবনে স্বাদ আহ্লাদ ও নেই!! ভিডিওতে আড়ালেই থেকে যাবে মিশনারীর উদ্দেশ্য, দরীদ্র মানুষদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা দেয়ার মহান ব্রত, সর্বোপরি ধর্মীও চেতনা।
হানিফ সাহেব সবচেয়ে খারাপ কাজ যেটা করেছেন, সেটা প্রয়াত ডা. বেকার আসলেই মেডিকেল গ্রাজুয়েট কিনা খুঁজে দেখেননি। উনি ভাল করে জানেননি বাংলাদেশেরই কয়েকজন ডা. এই সেন্টারের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ডা. বেকার গ্রাজুয়েট কোন ডাক্তারের কাছে সেন্টার না দিয়ে প্যারামেডিক্স দিয়ে চালিয়েছেন।
পাঠক, মিল খুজে পাচ্ছেন? কাইলাকুরের ডা. বেকারের সাথে উপরের ঘটনার? এটাই হচ্ছে সেই কাহিনী যেটা আড়ালে আছে। এই সেই রহস্য যে কারনে ডা. বেকার, মাদার তেরেসা, বা বড়দলের উক্ত জর্ডান ভদ্রলোক কেউ বিয়ে করেননি।
এবার অন্য ঘটনায় যাই। পাইকগাছায় যে যায়গায় আমি বসি সেটা একটা ডায়াবেটিক সেন্টার। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির একটা অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রতি শুক্রবার বিএমএ’র কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ডা. শহীদুল্লাহ বিনামূল্যে যে পরিমান ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী দেখেন এবং প্রতি ইউনিয়নে ফ্রি ক্যাম্পের নামে যে পরিমান রোগী ওষুধসহ ফ্রি দেখেন, ডা. বেকার তার ভগ্নাংশ পরিমান রোগীও চোখে দেখেননি। কই জনাব হানিফ সাহেব ডা. শহীদুল্লাহকে নিয়ে তো ইত্যাদিতে প্রচার করেননি? নাকি প্রচারের জন্য সাদা চামড়ার হতে হবে, খ্রীশ্চিয়ান মিশিওনারীর লোক হতে হবে, সারা জীবন বিয়ে না করে থাকতে হবে আর সুদুর আমেরিকা থেকে ক্যাথলিক ধর্মীয় আবেগে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মানব সেবা করতে হবে?
এদেশের আনাচে কানাচে এই রকম বহু ডাক্তার স্রেফ বিনামূল্যে রোগী দেখে যাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা ব্যাপারটায় রোগী, সমাজ ব্যবস্থা, আর্থিক অগ্রগতি অনেক কিছুই জড়িত। একদিন একটা রোগী ফ্রি দেখে দিলাম, আর তার রোগের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার হয়ে গেল?
ব্যাপারটা মোটেও এমন না। এখানে পর্যাপ্ত ফলোআপ, মনিটরিংয়ের দুর্বলতা আছে আমাদের। এইটা ডাক্তারদের সমস্যা নয়। এটা সমগ্র দেশের কাঠামোগত সমস্যা। আরো সময় লাগবে ক্যাপাসিটি বিল্ড আপ করতে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমাদের দেশের প্রচুর ডাক্তার অনেকটা মিশনারির মত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারাও মানুষ, আর তাদের সেবা দেয়াও কিন্তু মানব সেবা। কই তাদের নামে কোন প্রতিবেদন দেখেছেন? নাকি কালো চামড়া বলে একটা সমস্যা? খোদ ডা. বেকারের হাসপাতালেই প্রতি সপ্তাহে গনস্বাস্থ্য মেডিকেলের দুই জন ডাক্তার বিনামূল্যে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ইত্যাদির ভিডিও রিপোর্টে সেই তথ্য কই গেল? নাকি মানুষে দেশীয় ডাক্তারের নিউজ খাবে না?
এদেশে বিএনএসবি চক্ষু ক্যাম্প, ফি ঠোঁটকাটা তালুকাটার অপারেশন, ফ্রি ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসাসহ প্রচুর সামাজিক কাজ ডাক্তাররা বিনামূল্যে মানবতার জন্যে করে আসছে। শুধু কালো চামড়ার কারণে ধরা খেয়ে যাচ্ছে। হানিফ সাহেবের চৌখের উপ্রে দিয়ে যাচ্ছে, রাতারাতি কসাই হয়ে যাচ্ছে।
এবার আমাদের কথা বলি। ডাক্তারি একটা পেশা। রিক্সা চালানো, জুতা সেলাই, ফল বিক্রি, সবই পেশা। জীবিকার তাগিদেই সবাই করে। বাঙালী একটা সার্কাস প্রিয় জাতি। এই জাতির কোন রোগীরে দুই হাজার টাকার টেস্ট দিবেন, দশ হাজার টাকার ওষুধ লিখবেন, কোন সমস্যা নেই। শুধু ডাক্তার দুইশ টাকা ভিজিট নেয়নি মানে ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছে। আর ফাউ খাওয়া জাতির কাছে ফাউ যে কোন জিনিসই সার্কাসের মত।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে দেখেছি পুরো ওয়াজ মাহফিলের মত অবস্থা। অথচ পার্থক্য শুধু ভিজিটটা নিবে না এই আর কি! আর সব একই। পুরো চিকিৎসা ব্যয়ের ডাক্তারের ভিজিট মাত্র ৮%। বাকি ৯২ % এ তাদের কোন সমস্যা নেই। ভিজিট নিলেই কসাই। আর না নিলে ডাক্তার খুইব ভালো, এ রকম ডাক্তার হয় না।
কেন ভাই? আমার পরিবার আছে, বাচ্চা কাচ্চা আছে। তাদের টাকা লাগে না? ডাক্তারির বাইরে তো আর কিছু করি না। আমি আমার কর্মস্থলে বাড়িতে কোন রোগী দেখতে গেলে ভিজিট নেই ১০০০/- টাকা। অথচ গ্রামের বাড়িতে সপ্তাহে প্রায় দেড় দিনে যে পরিমান রোগী ফ্রি দেখি তার বাজার মূল্য মাসেই হবে লক্ষাধিক টাকা। এই ফ্রি চিকিৎসার মূল্যটুকুও মানুষ দেয় না। বলে- “রব না ক্যাডা আছে না? হেই আইসে ওষুধ দিছে”।
আমি আমার পরিমন্ডলে “রব না ক্যাডা” হয়েও বাজার মূল্যে মানুষকে লক্ষাধিক টাকার সেবা দেই। আমার পরিচিত, অপরিচিত, সেমি পরিচিত প্রায় সকল ডাক্তারই একই কাজ করেন। সমস্যাটা হল একই ফাও জিনিস সাদা চামড়ার কোন মানুষ দিলে ভাইরাল হবে। অন্যথায় নয়।
আবার ইত্যাদিতে ফিরে আসি। ডা. বেকার মেডিকেল গ্রাজুয়েট নন, একজন প্যারামেডিক। বর্তমানে যে দম্পত্তি এসেছেন উনারাও সমগোত্রীয়। ধর্ম প্রচার হোক, আর মানব সেবা হোক যে উদ্দেশ্যেই উনারা এসেছেন না কেন, উনাদের সাধুবাদ দেই। শুধু যারা লজ্জা পাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- ডা. বেকারের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি একটি মিশনারি হাসপাতাল। এটা বিদেশী ডোনেশনে চলে। কিছু স্থানীয় দানও আছে। যারা এখানে কাজ করছেন একেবারে ফ্রী নয়, মিশন থেকে টাকা পান। ক্যাথলিক খ্রিশ্চিয়ান মিশন। উদ্দেশ্য এতক্ষনে বুঝে ফেলেছেন।
বাংলাদেশের কিছু ডাক্তার এখানে একই সিস্টেমে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছিল। স্বয়ং ডা. বেকার অপারগতা দেখিয়ে বলেছিলেন- দেশি ডাক্তারে মিশনের ফান্ডিংয়ে সমস্যা হবে। এইখানে কে কাজ করবে সেটা মিশনের ব্যাপার। এর পরেও গনস্বাস্থ্য মেডিকেলের দুই জন ডাক্তার প্রতি সপ্তাহে ফ্রি চিকিৎসা দেয় সেখানে। ইত্যাদির রিপোর্টে অত্যন্ত চতুরতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সেটি এবং আমার মত গ্রামে পড়ে থাকা ডাক্তারদের কে স্রেফ অপমান করা হয়েছে।
(ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত)